রাউটার কি? রাউটারের প্রকারভেদ, ব্যবহারবিধি ও সুবিধা

রাউটার (Router) হার্ডওয়্যার ও সফটওয়্যারের সমন্বয়ে তৈরি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি স্মার্ট যন্ত্র। রাউটার কি এবং রাউটার সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য জেনে নিন এই আলোচনায়।

রাউটার বিভিন্ন ইলেকট্রনিক ডিভাইসের মধ্যে নেটওয়ার্ক স্থাপন করে এবং ইন্টারনেট সংযোগ পরিচালনা করে। বর্তমানে আমরা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তারবিহীন রাউটার ব্যবহার করে থাকি। এই রাউটারগুলো সাধারণত হার্ডওয়্যার ভিত্তিক হলেও সফটওয়্যার ভিত্তিক রাউটারের ব্যবহার বৃদ্ধি পাচ্ছে প্রতিনিয়তই।

বহুল ব্যবহৃত এই রাউটার কি, রাউটারের যন্ত্রাংশ, বৈশিষ্ট্য, বিভিন্ন প্রকার রাউটার ও কিভাবে কাজ করে সে সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য নিচে তুলে ধরা হলো।

রাউটার একটি বিশেষ যন্ত্র যা আধুনিক ইলেকট্রনিক ডিভাইস গুলোর মধ্যে ইন্টারনেট সংযোগ স্থাপন করে। বর্তমানে মোবাইল, ডেস্কটপ, ল্যাপটপ, টিভি ও প্রিন্টার এবং অন্যান্য স্মার্ট ডিভাইস গুলোতে ইন্টারনেট সংযোগ স্থাপনের জন্য রাউটার বিশেষভাবে ব্যবহৃত হয়। সর্বপ্রথম ১৯৭৫-৭৬ সালের দিকে আইপি রাউটার আবিষ্কৃত হয়েছিল।

রাউটার কি

বর্তমান সময়ে আমরা যে রাউটারগুলো ব্যবহার করে থাকি, সেগুলোকে ওয়াই-ফাই রাউটার বলা হয়। ওয়াইফাই সুবিধার পাশাপাশি আরো বহু ফিচার রয়েছে এই রাউটার গুলোতে।

  • রাউটার একটি নেটওয়ার্ক লেয়ার ডিভাইস।
  • রাউটারকে ল্যান (Local Area Network) এবং WAN (Wide Area Network) উভয় ক্ষেত্রেই ব্যবহার করা যায়।
  • রাউটার আইপি প্যাকেট আকারে ডেটা স্থানান্তর করে।
  • ডেটা স্থানান্তর করতে রাউটার IP প্যাকেটের পথে সংজ্ঞায়িত IP Address ব্যবহার করে।
  • রাউটারে একটি রাউটিং টেবিল থাকে, যা নেটওয়ার্কের পরিবর্তন অনুসারে বিভিন্ন সময় রিফ্রেশ হয়।
  • রাউটার বিভিন্ন নেটওয়ার্ককে একসাথে সংযুক্ত করে একটি নেটওয়ার্ক থেকে অন্য নেটওয়ার্কে ডাটা প্যাকেট স্থানান্তর করে
  • রাউটিং টেবিল প্রস্তুত কিংবা রিফ্রেশ করতে রাউটার একে অপরের মধ্যে তথ্য বিভক্ত করে।
  • রাউটার অন্যান্য নেটওয়ার্কিং ডিভাইস, যেমন- ব্রিজ, হাব এবং সুইচের চেয়ে বেশি ব্যয়বহুল হয়।

রাউটার একটি স্মার্ট ডিভাইস। এই রাউটার কিছু যন্ত্রাংশের সমন্বয়ে তৈরি। নিচে রাউটারের প্রধান যন্ত্রাংশ গুলো সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত তথ্য তুলে ধরা হলোঃ

(১) সিপিইউ বা Central Processing Unit

অধিকাংশ ইলেকট্রনিক ডিভাইসের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো সিপিইউ। অন্যান্য স্মার্ট ডিভাইস গুলোর মত রাউটারেরও সকল যন্ত্রাংশ গুলো পরিচালনার জন্য সিপিইউ ব্যবহৃত হয়। এক্ষেত্রে বিভিন্ন অপারেটিং সিস্টেম রয়েছে। যেমন: Juniper, Junos এবং Cisco IOS।

(২) র‍্যাম RAM

রাউটার চালু থাকা অবস্থায় অপারেটিং সিস্টেম র‌্যামে লোড হয়। এখান থেকেই রাউটার রুট নির্ধারণ করে। রাউটিং টেবিল, এআরপি টেবিল, রাউটিং মেট্রিক্স ইত্যাদি ডাটা র‌্যামের ভিতরে সংরক্ষণ করা হয়। এগুলোর সাহায্যে প্যাকেট ফরওয়ার্ডিং প্রসেস স্পিড করা হয়।

(৩) ফ্ল্যাশ মেমোরি

প্রতিটি ইলেকট্রনিক ডিভাইসের অপারেটিং সিস্টেম পরিচালনা করতে ফ্ল্যাশ মেমোরি প্রয়োজন হয়। রাউটারেও একটি ফ্লাশ মেমোরি রয়েছে। এই ফ্ল্যাশ মেমরিতে রয়েছে রাউটিং টেবিল, রাউটিং অ্যালগরিদম ও রাউটিং প্রোটোকল।

(৪) নন ভোলাটাইল মেমোরি

এটি রাউটারের একটি পার্মানেন্ট মেমোরি। এর মধ্যে অপারেটিং সিস্টেমের ব্যাক আপ এবং স্টার্টআপ সংস্করণ সংরক্ষণ করা রয়েছে। রাউটার যখন বুট হয়, তখন এই মেমোরি থেকেই প্রোগ্রাম লোড হয়।

(৫) নেটওয়ার্ক ইন্টারফেস

রাউটারেরং অপারেটিং সিস্টেমে অনেক ড্রাইভার থাকে। এগুলো রাউটারের কোন পোর্টে কোন নেটওয়ার্কের তার সংযুক্ত রয়েছে তা জানাতে পারে। এর মাধ্যমে অন্যান্য রাউটার থেকে রুট নিয়ে ডাটা প্যাকেটটি সঠিক রুটে প্রেরণ করে।

(৬) কনসোল

রাউটার কিভাবে কনফিগারেশন ও পরিচালনা করে তার সমস্ত কর্মকাণ্ড কনসোল নিজেই করে থাকে। রাউটারের কনফিগারেশন এবং ট্রাবলশুটিং কমান্ড গুলো console থেকে দেওয়া হয়।

আমাদের মোবাইল, ডেক্সটপ, ল্যাপটপের ইন্টারনেট কানেকশনের জন্য সাধারণত এক ধরনের রাউটার ব্যবহার করে থাকি। তবে রাউটারের বেশ কয়েকটি প্রকার রয়েছে। নিচে সবচেয়ে বেশি পরিচিত এবং প্রধান ৫ প্রকারের রাউটার সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা হলোঃ

এ ধরনের রাউটারের সাথে ইন্টারনেট কানেকশনের জন্য সংযুক্ত প্রতিটি যন্ত্রই তার দ্বারা যুক্ত থাকে। সাধারণত প্রচলিত রাউটার গুলোতে শুধুমাত্র ব্রডব্যান্ড এর সাথে রাউটার সংযুক্ত করতে তার ব্যবহৃত হয়। তবে তারযুক্ত রাউটারের সাথে যে সকল যন্ত্র তার দ্বারা সংযুক্ত থাকে শুধুমাত্র সেগুলোই ইন্টারনেট কানেকশন পায়। বর্তমানে অতিরিক্ত তারযুক্ত হওয়ায় এ ধরনের রাউটারের ব্যবহার তেমন দেখা যায় না।

এ ধরনের রাউটার কিছু নির্দিষ্ট কর্মক্ষেত্রের/অফিসার কম্পিউটার গুলো ইন্টারনেট সংযোগের আওতায় আনতে এ ধরনের রাউটারের কানেকশন ব্যবহার করা হয়। এ ধরনের রাউটার সহজে হ্যাক করা যায় না। কারণ ইন্টারনেট কানেকশন ও সকল প্রকার তথ্য আদান-প্রদান হয় তারের মাধ্যমেই। সরাসরি তার দ্বারা ডিভাইসের সাথে রাউটারের সংযোগ থাকায় ইন্টারনেটের গতি থাকে অনেক বেশি।

রাউটার কি

বর্ধমানের সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয় তারবিহীন রাউটার। তারযুক্ত রাউটারের মতোই ব্রডব্যান্ডের সাথে এই রাউটারের সংযোগ থাকে। তবে ইন্টারনেট কানেকশনের জন্য অন্যান্য ডিভাইস, যেমন- কম্পিউটার, ডেস্কটপ, ল্যাপটপ, মোবাইল ইত্যাদি তার দ্বারা সংযুক্ত করতে হয় না। ইন্টারনেট কানেকশন প্রদানের জন্য এটি ওয়াই-ফাই পদ্ধতির উপর নির্ভরশীল হয়।

আরও পড়ুন: ই নামজারি যাচাই বা খতিয়ান অনুসন্ধানের পদ্ধতি

এ ধরনের রাউটারে ব্রডব্যান্ড সংযোগের মাধ্যমে পরিচালিত হওয়া বিভিন্ন ডাটা প্যাকেজ গুলো রেডিও তরঙ্গে পরিণত হয়। তারপর নির্দিষ্ট সীমানার মধ্যে থাকা বিভিন্ন ইলেকট্রনিক স্মার্ট ডিভাইস গুলোতে রাউটারের ইন্টারনেট কানেকশন ছড়িয়ে পড়ে।

ভিপিএন রাউটার গুলো ওয়্যারলেস রাউটারের মতই কাজ করে থাকে। তবে ওয়্যারলেস/ তারবিহীন রাউটারের সাথে ভিপিএন রাউটারের মূল পার্থক্য হলো রাউটার উৎপাদনের সময়ই রাউটারে – ‘VPN client software’ ইনস্টল করা থাকে। এসকল রাউটারের সাথে যেই ডিভাইস গুলো কানেক্ট করা হয় সেই ডিভাইস গুলো পূর্বেই ভিপিএন থেকে ইন্টারনেট সরবরাহ করে থাকে।

সাধারণত আইএসপি বা ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডাররা যে রাউটারগুলো ব্যবহার করে তাকে এজ রাউটার বলা হয়। ইংরেজি ‘Edge’ – শব্দের অর্থ প্রান্ত। মূলত একটি নেটওয়ার্কের প্রান্তে অপর একটি নেটওয়ার্কের সাথে সংযোগ স্থাপনের জন্যই এজ রাউটার ব্যবহৃত হয়। এদেরকে প্রান্তিক রাউটারও বলা হয়ে থাকে।

এই ধরনের রাউটার কিছু স্মার্ট ডিভাইস গুলোর সাথে সংযুক্ত হয়ে নেটওয়ার্ক স্থাপন করে না। বরং একটি আইএসপিও থেকে ব্রডব্যান্ড সেবা গ্রহণকারী সকল গ্রাহকদের রাউটার নিয়ে একটি বড় নেটওয়ার্ক স্থাপন করে।

ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডারদের কাছ থেকে গ্রাহকদের কাছে নেটওয়ার্ক সংযোগ পৌঁছে দিতে দুইটি নেটওয়ার্কের মধ্যে যেই যন্ত্রটির প্রয়োজন হয় সেটিই এডজ রাউটার নামে পরিচিত। এ ধরনের রাউটার উচ্চহারে ইন্টারনেট কানেকশন আদান-প্রদান করতে পারে।

সাধারণত গৃহ, অফিস-আদালত, বিদ্যালয়ে ইন্টারনেট সংযোগ আদান প্রদানের জন্য এই রাউটার ব্যবহার করা হয় না। বরং ইন্টারনেট সার্ভিস প্রদানকারীরাই তাদের সেবার গতি অব্যাহত রাখার জন্য এটি ব্যবহার করে।

উপরোক্ত এডজ রাউটার দুটি নেটওয়ার্কের মধ্যে উচ্চমাত্রায় ইন্টারনেট কানেকশন আদান-প্রদানের জন্য ব্যবহৃত হয়। তবে কোর রাউটার একটি নেটওয়ার্কের মধ্যেই তার কাজ সম্পাদন করে। বিশেষভাবে কোন বড় নেটওয়ার্কের তথ্য আদান প্রদানের গতিশীলতা বজায় রাখতে কাজ করে।

যেমন- আঞ্চলিক সংযোগ, বৃহৎ কোন প্রতিষ্ঠানের আন্তঃসংযোগ কিংবা কোন আইএসপি এর মধ্যে আইপি সংযোগ স্থাপন, এন্টারপ্রাইজ রাউটার, বড় ব্যবসা বা আইএসপি নেটওয়ার্ককে শক্তিশালী কেন্দ্রীয় রাউটারের সাথে সংযুক্ত করতে কেন্দ্রীয় রাউটার ডাটাকে অপটিক্যাল ফাইবার লাইনের মধ্য দিয়ে দ্রুতগতিতে ইন্টারনেটে প্রেরণ করে। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ব্যবহৃত এরকম রাউটারের সংযোগ আদান-প্রদানের গতি অনেক বেশি থাকে।

নির্বিঘ্নে উচ্চগতির ইন্টারনেট সংযোগের জন্য আমরা রাউটার ব্যবহার করে থাকি। বর্তমানের তারবিহীন রাউটার গুলোর ওয়াই-ফাই এর মাধ্যমে আমরা কম্পিউটার, ডেস্কটপ, ল্যাপটপ, মোবাইল ইত্যাদি স্মার্ট ডিভাইস গুলোতে ইন্টারনেট সংযোগ দিয়ে থাকি। ইন্টারনেট সংযোগ ছাড়াও রাউটার আরও বিভিন্ন কাজে ব্যবহৃত হয়।

আরো পড়ুন: চন্দ্রযান- এর চন্দ্র জয়ের কথা

রাউটারের ব্যবহার সম্পর্কে জানলেও এর কার্য সম্পাদন প্রক্রিয়া সম্পর্কে আমাদের অনেকেরই অজানা। তাই রাউটার কিভাবে কাজ করে তা নিচে তুলে ধরা হলোঃ

আমরা যেই তারবিহীন রাউটার ব্যবহার করে থাকি সেগুলোর কার্য পদ্ধতি অন্যান্য রাউটার থেকে বিভিন্ন। সাধারণত এই রাউটার গুলো বিভিন্ন নেটওয়ার্কের দুই বা ততোধিক ডাটা লাইনের সাথে সংযুক্ত থাকে। প্রথমত ব্রডব্যান্ড এর মাধ্যমে কোন একটি ডাটা প্যাকেজ এই লাইনগুলোর একটিতে পৌঁছে যায়। তখন রাউটার সেই প্যাকেজ গুলোর চূড়ান্ত গন্তব্য জানতে ডাটা প্যাকেজের তথ্য বিশ্লেষণ করে।

তারপর রাউটার তার নিজস্ব রাউটিং টেবিল বা রাউটিং পলিসিতে লিপিবদ্ধ থাকা তথ্যের সাহায্যে প্যাকেজটিকে তার গন্তব্যের পরবর্তী নেটওয়ার্কে পাঠিয়ে দেয়। এভাবেই ব্রডব্যান্ড থেকে ইন্টারনেট সংগ্রহকারী স্মার্ট ডিভাইসে আন্তঃ নেটওয়ার্কের একটি আস্তরণ তৈরি হয়।

সহজভাবে বলতে গেলে আইএসপি থেকে ব্রডব্যান্ড সংযোগের মাধ্যমে তথ্য রাউটারে পৌঁছে যায়। রাউটার সেই তথ্যের সঠিক গন্তব্য বিশ্লেষণ করে মোবাইল, ডেক্সটপ বা ল্যাপটপে পাঠিয়ে দেয়। এভাবেই আমরা খুব সহজে রাউটারের ওয়াই-ফাই কানেকশন ব্যবহার করে উচ্চগতির নেটওয়ার্ক ব্যবহার করতে পারি।

উপরোক্ত আলোচনায় রাউটার কি এবং রাউটার সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। রাউটার ক্রয়ের পূর্বে আপনার জন্য কোন রাউটারটি উপযুক্ত তা বিচার-বিশ্লেষণ করে নিন। এছাড়াও রাউটারের সঠিক ব্যবহারবিধি জেনে তার সর্বোচ্চ সুবিধা পেতে পারেন।

Scroll to Top