নামকরণ: ইতিহাসবিদদের ধারণা রাজা শশাঙ্কের শাসনামলে অর্থাৎ সপ্তম শতাব্দীতে এই অঞ্চলে একটি ছোট শহর বা নগরীর অস্তিত্ব ছিল। পরবর্তীতে ১৬১০ সালে মোগল সম্রাট জাহাঙ্গীরের ফরমান অনুযায়ী ঢাকা হলো সুবাহ বাংলার রাজধানী। এভাবে সময়ের সাথে সাথে ঢাকা যেভাবে তার পরিচয় পেয়েছে, সেভাবেই ঢাকার বিভিন্ন অঞ্চল বা এলাকাও পেয়েছে ভিন্ন ভিন্ন সব নাম। আর এসকল নামের পেছনে লুকিয়ে আছে মজার কিছু ইতিহাস।
উপমহাদেশের যেকোনো শাসকের সৈন্যবাহিনীতেই হাতির গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। আধুনিক যুদ্ধকৌশল বা যুদ্ধাস্ত্র আসার আগে হাতিই ছিল ট্যাংকের সমকক্ষ সমরাস্ত্র। যার কাছে যত বেশি হাতি আছে, তার যুদ্ধ জয়ের সম্ভাবনা ততই বেশি। আর এই একই কারণে মোগল আমলে আমাদের ঢাকাতেও হাতির প্রশিক্ষণ ও রক্ষণাবেক্ষণ হতো। আর এই হাতিদের সাথেই জুড়ে আছে ঢাকার ৫টি এলাকার নামের ইতিহাস। আজকের গল্পে আমরা জানছি সেই নাম গুলোর ইতিহাস।
নামকরণ
১. পিলখানাঃ পিলখানা শব্দটি আসে ফিলখানা থেকে। আরবি শব্দ ফিল-এর অর্থ হাতি। কুরআনে ফিল নামে একটি পূর্ণাঙ্গ সূরা রয়েছে। ফিলের বিকৃতি রূপ পিল। আর খানা অর্থ আশ্রম। অর্থাৎ হাতির আশ্রমকেন্দ্রকে বলা হতো পিলখানা। জায়গাটিতে প্রচুর হাতি পালা হতো। মোগলরা আসার পর এ জায়গায় হাতি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র তৈরি করেন তারা। জায়গাটি বর্তমানে পিলখানা নামে পরিচিত।
২. এলিফ্যান্ট রোডঃ পিলখানা থেকে চরানোর জন্য রমনায় নিয়ে আসা হতো হাতির পাল। এসময় যে পথটি ব্যবহৃত হতো, ব্রিটিশ আমলে তাই এলিফ্যান্ট রোড নাম নেয়।
৩. হাতিরপুলঃ এলিফ্যান্ট রোডে আবার ছিল জলাভূমি। চলাচলের সময় হাতিগুলোর পা দেবে যেত। এজন্য বর্তমান ইস্টার্ন প্লাজা ও পরিবাগ বরাবর একটি পুল নির্মাণ করা হয়েছিল। সেই থেকে এলাকাটির নাম হয়ে গেল হাতিরপুল।
৪. হাতিরঝিলঃ পিলখানা থেকে রমনায় পৌঁছোনোর পথে জলাশয় ছিল। সেখানে কর্দমাক্ত হাতিগুলো গোসলের জন্য পাশে থাকা বড় একটি ঝিলে নামত। এটিই মূলত হাতিরঝিল হিসেবে পরিচিত।
৫. মাহুতটুলিঃ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলে পিলখানায় নির্দিষ্ট ফি-র বিনিময়ে হাতি পোষ মানাতে পাঠাতেন জমিদাররা। হাতিদের রক্ষা ও দেখাশোনা করতেন মাহুতরা। তাই পিলখানার আশেপাশের এলাকায় থাকতেন তারা। এজন্য আবুল হাসনাত রোড থেকে ওল্ড ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে যাওয়ার রাস্তাটি মাহুতটুলি হিসেবে পরিচিত।
এছাড়া ঢাকা শহরের বিভিন্ন এলাকার নামকরণের ইতিহাসঃ
টিকাটুলিঃ হুক্কার প্রচলন ছিলো। হুক্কার টিকার কারখানা ছিলো যেথায় সেটাই “টিকাটুলি”।
ভুতের গলিঃ এখানে বৃটিশ একজন লোক থাকতেন নাম ছিল Mr. boot, তার নাম থেকে বুটের গলি, পরবর্তীকালে ভুতের গলি নাম হয়েছে।
ইন্দিরা রোডঃ এককালে এ এলাকায় “দ্বিজদাস বাবু” নামে এক বিত্তশালী ব্যক্তির বাসাস্থান, অট্টলিকার পাশের সড়কটি নিজেই নির্মাণ করে বড় কন্যা “ইন্দিরা” নামেই নামকরণ।
কাকরাইলঃ ঊনিশ শতকের শেষ দশকে ঢাকার কমিশনার ছিলেন মিঃ ককরেল। নতুন শহর তৈরী করে নামকরণ হোলো “কাকরাইল”।
আরো পড়ুন: চন্দ্রযান-৩ এর চন্দ্র জয়ের কথা
রমনা পার্কঃ এই এলাকায় বিশাল ধনী রমনাথ বাবু মন্দির তৈরী করেছিলো “রমনা কালী মন্দির”। মন্দির সংলগ্ন ছিলো ফুলের বাগান আর খেলাধুলার পার্ক। পরবর্তীতে সৃষ্টি হয় “রমনা পার্ক”।
গোপীবাগঃ গোপীনাগ নামক এক ধনী ব্যবসায়ী ছিলেন। নিজ খরচে “গোপীনাথ জিউর মন্দির” তৈরী করেন। পাশেই ছিলো হাজারো ফুলের বাগান “গোপীবাগ”।
তোপখানাঃ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর গোলন্দাজ বাহিনীর অবস্থান ছিল এখানে।
পুরানা পল্টন, নয়া পল্টনঃ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর ঢাকাস্থ সেনানিবাসে এক প্ল্যাটুন সেনাবাহিনী ছিল, প্ল্যাটুন থেকে নামকরন হয় পল্টন। পরবর্তীতে আগাখানিরা এই পল্টনকে দুইভাগে ভাগ করেন, নয়া পল্টন ছিল আবাসিক এলাকা আর পুরানো পল্টন ছিল বানিজ্যিক এলাকা।
মহাখালিঃ মহা কালী নামের এক মন্দীরের নাম থেকে হয়েছে বর্তমানের মহাখালী।
পরীবাগঃ পরীবানু নামে নবাব আহসানউল্লাহর এক মেয়ে ছিল। সম্ভবত পরীবানুর নামে এখানে একটি বড় বাগান করেছিলেন আহসানউল্লাহ।
ধানমন্ডিঃ এখানে এককালে বড় একটি হাট বোসতো। হাটটি ধান ও অন্যান্য শস্য বিক্রির জন্য বিখ্যাত ছিল।
ফার্মগেটঃ কৃষি উন্নয়ন, কৃষি ও পশুপালন গবেষণার জন্য বৃটিশ সরকার এখানে একটি ফার্ম বা খামার তৈরি করেছিল। সেই ফার্মের প্রধান ফটক বা গেট থেকে এলাকার নাম হোলো ফার্মগেট।
শ্যামলীঃ ১৯৫৭ সালে সমাজকর্মী আব্দুল গণি হায়দারসহ বেশ কিছু ব্যক্তি এ এলাকায় বাড়ি করেন। এখানে যেহেতু প্রচুর গাছপালা ছিল তাই সবাই মিলে আলোচনা করে এলাকার নাম রাখেন শ্যামলী।
সূত্রাপুরঃ কাঠের কাজ যারা করতেন তাদের বলা হত সূত্রধর। এ এলাকায় এককালে অনেক সূত্রধর পরিবারের বসবাস ছিলো । সেই থেকেই জায়গার নাম হোলো সূত্রাপুর।
গেন্ডারিয়াঃ ইংরেজি শব্দ Grand Area থেকে এসেছে, এখানে আগের দিনের অভিজাত ধনী ব্যাক্তিগন থাকত।
গুলিস্তানঃ বর্তমান গুলিস্তান নামক স্থানটিতে পাকিস্তান আমলে একটি সিনেমা হল ছিল। যার নাম ছিল গুলিস্তান। সেই হল কে কেন্দ্র করে পুরো এলাকাটির নাম গুলিস্থান।
তথ্যসূত্রঃ মুনতাসীর মামুন, “ঢাকা : স্মৃতি বিস্মৃতির নগরী”
সম্মানিত ভিজিটর আমি আব্দুল কাইয়ুম, পেশায় আমি একজন গণমাধ্যমকর্মী। ব্লগ বলেন আর সংবাদ বলেন এটাই আমার নেশা ও পেশা। এই ব্লগের মাধ্যমে ভিজিটরদের সঠিক তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করাই আমার ছোট্ট প্রয়াস মাত্র।