বর্তমান পৃথিবীতে মোট জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক নীল জিন্স ব্যবহার করে থাকে। বিশ্বব্যাপী এর প্রচলন হয়েছিল বহুকাল পূর্ব থেকেই। তবে আজ তা সকালের কাছেই পছন্দনীয়। কিন্তু বেশিরভাগ জিন্স নীল হওয়ার কারণ কি তা আমাদের অনেকেরই অজানা।
নীল রঙ খুব সহজেই মানুষের মনে স্বাচ্ছন্দ্যের অনুভূতি জাগিয়ে তোলে। এটি সকলের মনে ব্যাপক প্রভাব ফেলে। তাছাড়া এই রং সকলের মনে তীব্র আকর্ষণ সৃষ্টি করে। নীল রঙ গণতন্ত্র, কঠোর পরিশ্রম, সমতা এবং স্বাধীনতার, প্রশান্তি, বিশ্বাস এবং নির্ভরযোগ্যতার প্রতীক হিসেবে অন্যতম উপাদান।
বহুকাল পূর্ব থেকেই নীল রঙের প্যান্ট স্থায়িত্ব, টেকসই, সৌন্দর্যের জন্য অনেক বেশি ব্যবহার হয়ে আসছে। হয়তো আপনিও নীল জিন্স ব্যবহার করে থাকেন। তাই বেশিরভাগ জিন্স নীল হওয়ার কারণ সম্পর্কে জেনে নিন এই আলোচনায়।
নীল জিন্সের তৈরির ইতিহাস | জিন্স নীল হওয়ার কারণ কি?
১৯ শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নীল জিন্স ব্যবহার করা হচ্ছে। নীল জিন্স প্রাথমিকভাবে ১৬ শতকের দিকে প্রতি উৎপাদিত হলেও, তখন এর প্রচার ও প্রসার তেমন হয়নি। পরবর্তীতে ১৮৭৩ সালে এটি জনপ্রিয়তা লাভ করে। নীল জিন্সের কোম্পানীর উৎপত্তি হয়েছিল লেভি স্ট্রস (1829-1902) এর মাধ্যমে।
তিনি একজন বাভারিয়ান অভিবাসী, যিনি গোল্ড রাশের সময় ১৮৫০ সালে সান ফ্রান্সিসকোতে এসেছিলেন। তিনি খনি শ্রমিকদের কাছে বিক্রির জন্য শুকনো পণ্য নিয়ে এসেছিলেন। টেকসই প্যান্টের জন্য খনি শ্রমিকদের প্রয়োজনীয়তার কথা শুনে, স্ট্রস তাঁবুর ক্যানভাস থেকে পোশাক তৈরি করার জন্য একজন দর্জিকে নিয়োগ করেছিলেন।
লেভি স্ট্রস নেভাদার দর্জি জ্যাকব ডব্লিউ ডেভিস রিভেট রিইনফোর্সড ডেনিম জোড়া তৈরির জন্য নিয়োগ করেছিলেন। নীল জিন্সের জনপ্রিয়তা ডেভিসের ছোট দোকানের সীমার বাইরে চলে গিয়েছিলো। তাই এর বিক্রয় এবং উৎপাদনকে বাড়ানোর জন্য শুকনো পণ্যের পাইকারি বিক্রেতা লেভি স্ট্রস অ্যান্ড কোং দিকে দিকে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। লেভি স্ট্রস নীল জিন্স বাজারে নিয়ে আসে এবং তার বিক্রয় বহুলাংশে বৃদ্ধি করে।
লেভি স্ট্রস ১৮৭৩ সালের দিকে এই প্যান্টের পেটেন্ট নেন। তখন সেখানে শ্রমিকরা নীল ডেনিম প্যান্ট পরতে শুরু করেন। পূর্বে বিভিন্ন কলকারখানার ও খনির শ্রমিকরা বাদামি বা ধূসর রঙের প্যান্ট ব্যবহার করতো। কর্মক্ষেত্রে তাদের প্যান্ট ও সম্পূর্ণ ইউনিফর্ম অনেক বেশি ময়লা হয়ে যেত। কিন্তু নতুন নতুন বাজারে আসা নীল জিন্স ছিল তা থেকে ভিন্ন। এটি ছিল বেশিরভাগ জিন্স নীল হওয়ার কারণ।
নীল জিন্স অনেক বেশি টেকশই ছিল এবং কলকারখানার কাজের সময় ময়লা লেগে গেলেও তা বুঝা যায়নি। তাই অধিকাংশ শ্রমিকরাই নীল জিন্সকে তাদের ইউনিফর্ম হিসেবে বেছে নিয়েছিল। এবং নীল জিন্সের প্রচলন নিজ দেশের গণ্ডি পেরিয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ে।
লেভি স্ট্রসের জিন্সের ডিজাইন ছিলো তখনকার প্রচলিত বাদামী সুতার প্যান্টের প্রায় হুবহু। সেটি ‘ডাক ট্রাউজার’ নামে পরিচিত ছিল। কিন্তু তার মডেল পুরাতন হয়ে যাওয়ায় নীল জিন্সের জনপ্রিয়তা তৈরিতে বেশি সময় লাগেনি।
নীল জিন্স এর নকশা প্রনয়ন
লেভি স্ট্রস যেই জিন্সের পেটেন্ট তৈরি করেছিলেন, তার সামনের পকেটের উপরে ছিল আরেকটি ছোট পকেট। তৎকালীন সময়ে মানুষ সেই পকেটে ঘড়ি রাখতো। বর্তমানে যদিও সেই পকেটে এখন আর মানুষ ঘড়ি রাখে না। কিন্তু ডেনিম জিন্সের সেই ইতিহাস-ঐতিহ্যের ডিজাইন এখনো অব্যাহত আছে। বেশিরভাগ জিন্স নীল হওয়ার কারণ হিসেবে এই ডিজাইনের প্রভাবও অনেক।
১৮৮৬ সালে, লেভিস তার পোশাকে একটি চামড়ার প্যাচ সংযুক্ত দুটি ঘোড়া সহ একটি লোগো তৈরি করে। সেই লোগোটি আজও ব্যবহৃত হয়। সময়ের সাথে সাথে, জিন্সের আসল নকশাটি কিছুটা পরিবর্তিত হয়ে বর্তমান রূপ ধারণ করেছে। ১৯০১ সালের ডেনিম জিন্সের দ্বিতীয় পকেট যুক্ত করা হয়েছিল। পরবর্তীতে ১৯২২ সালে বেল্ট লুপগুলি যুক্ত করা হয়।
নীল জিন্স ব্যবহার ও প্রচলন
বর্তমানে আমরা যেই জিন্স প্যান্ট ব্যবহার করি, তার অধিকাংশই নীল রঙের হয়ে থাকে। ২০ শতক জুড়ে নীল জিন্স সস্তা ও টেকসই ইউনিফর্ম হিসেবে ব্যবহার হতে থাকে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে। যেমন: ফরাসি জাতীয় রেলওয়ের কর্মীদের ইউনিফর্ম হিসেবে ব্যবহার করা হতো।
বিশ্বযুদ্ধের সময়কালীন বছরগুলোতে সাধারণ কাজের জন্য রয়্যাল এয়ার ফোর্স এই নীল রঙের জিন্স ব্যবহার করেছিলেন। বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বিদ্রোহ এবং যুব সংস্কৃতির প্রতীক হয়ে ওঠে নীল জিন্স। তখন এর নামকরণ করা হয়েছিল ‘ডেনিমস’ (Denims)। জেমস ডিন অভিনীত ‘Reveal Without A Cause’’ সিনেমাটিতে ডেনিমের সাথে বিদ্রোহী চিত্র ফুটিয়ে তোলা হয়। যার কারণে এটি অনেক বেশি জনপ্রিয়তা পায়।
ধারণা করা হয়, নীল জিন্স তারুণ্যের স্বাধীনতার প্রতিক হিসেবে প্রতিনিধিত্ব করে। সংস্কৃতিকভাবে নীল জিন্সকে আরো বলা হয়েছে কঠোরতার প্রতীক। পাশাপাশি, ঐতিহ্যগত রীতিনীতি থেকে বিরতির প্রতীকও হয়ে ওঠে নীল রঙের জিন্স। এগুলোও বেশিরভাগ জিন্স নীল হওয়ার কারণ।

শুধু পূর্বের দিনগুলোতেই নয় বর্তমানে সকলেরই কমবেশি নীল জিন্স রয়েছে। পরিসংখ্যানে দেখা যায় আমেরিকানদের প্রত্যেকের গড়ে ৭ জোড়া নীল জিন্স রয়েছে। প্যান্ট হিসেবে বর্তমানে নীল জিন্সের ব্যবহারই সবচেয়ে বেশি দেখা যায়। ১৮৭৩ সাল থেকে শুরু করে বর্তমান সময় পর্যন্ত নীল রঙের জেন্টস তার মর্যাদা উন্মোচিত রাখতে সক্ষম হয়েছে।
জিন্সের নীল রঙ নির্বাচনের কারণ
লেভিস জিন্সের নীল রঙ বাছাই করার মূল কারণ ছিল খনির শ্রমিকদের ব্যবহারে উপযোগী করতে। খনির শ্রমিকরা অধিকাংশ সময় ধুলোবালিপূর্ন স্থানে কাজ করতো। ফলে তাদের পোশাকগুলো খুব সহজেই ধূসর বর্ণ ধারণ করতো। কিন্তু নীল রংয়ের জিন্স ধুলোবালিপূর্ণ স্থানে কাজ করার পরও পরিষ্কার মনে হতো।
উৎপাদনের সময় এই রংটি বাছাই করা হয়েছিল নীল ডাইয়ের রাসায়নিক উপাদানের কারণে। মূলত নীল রংটা আসে প্রাকৃতিক ইন্ডিগো ডাই থেকে। বেশিরভাগ ডাই তাপের সংস্পর্শে এলে কাপড়ের সঙ্গে শক্তভাবে লেগে যায় এবং অধিকাংশ ডাই কাপড়ের তন্তুর মধ্যে ঢুকে যেত। ফলে প্রতিবার ধোয়ার পরই কিছু তন্তু ও রং উঠে যায়। যে কারণে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে জিন্সকে দেখতে এত বিবর্ণ লাগে।
কিন্তু নীল ডাইয়ে তাপ দিলে সেটি শুধু কাপড়ের পৃষ্ঠভাগেই লেগে থাকে। জিন্স প্রথম ওয়ার্কওয়্যার পোশাক তৈরিতে ব্যবহৃত হয়েছিল। সেই সময় উদ্ভিদ থেকে তৈরি নীল রঙটি সবচেয়ে টেকসই রঙ ছিল। ডেনিম ফ্যাব্রিকের সাথে সেই নীল রঙটি ভালভাবে লেগে থাকত।
ধুলেও এই রঙ কাপড় থেকে মুছে যেত না। বেশিরভাগ জিন্স নীল হওয়ার কারণ হিসেবে এটি সবচেয়ে বেশি বিবেচনা করা হয়। এই স্থায়ীত্বের জন্যই নীল জিনস জনপ্রিয়তা লাভ করে। ধীরে ধীরে জিন্স আরও নরম ও পরিধানের উপযোগী হয়ে ওঠে। এই নরম জিন্সই শ্রমিকদের জন্য বেশি উপযোগী ছিল। তারা জিন্স পরে কাজ করতে স্বাচ্ছন্দ্য অনুভব করতেন।
নীল জিন্স কিসের প্রতীক
নীল রঙ অজান্তেই মানুষের মনে স্বাচ্ছন্দ্যের অনুভূতি জাগিয়ে তোলে। এই রঙ মানুষের মনে ব্যাপক প্রভাব ফেলে। নীল রঙ গণতন্ত্র, কঠোর পরিশ্রম, সমতা এবং স্বাধীনতার, প্রশান্তি, বিশ্বাস এবং নির্ভরযোগ্যতার প্রতীক হিসেবে ব্যবহারের উপযুক্ত।
আরো পড়ুন: রসুনের উপকারিত ও অপকারিতা
নিরপেক্ষ রঙ হিসেবে অন্যান্য রঙের তুলনায় নীল রঙের বহুমুখীতা রয়েছে। এই রঙটি অনেক বেশি স্থিতিশীল অনুভূতি জাগিয়ে তোলে। তাই নীল জিন্স মানুষের দৈনন্দিন পোশাকের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে এর প্রতি বেশিরভাগ মানুষ সহজেই আকৃষ্ট হয় এবং এটি বেশিরভাগ জিন্স নীল হওয়ার কারণ।
নীল জিন্সের উৎপাদন সুবিধা
শুধুমাত্র ব্যবহার, আকৃষ্টতা, ব্যবসায়িক প্রসারের ফলেই যে নীল জিন্সের উৎপাদন বেশি তা নয়। বরং শিল্প ও উৎপাদনের ক্ষেত্রেও এর সুবিধা রয়েছে অনেক। প্রতিটি নীল জিন্সের একটি অনন্য/ইউনিক রূপ রয়েছে। যা এর ব্যবহারকারীদের স্বতন্ত্রতা প্রকাশ করে। উৎপাদনের ক্ষেত্রে এই জিন্সের প্রয়োজনীয় উপাদান গুলো খুব সহজেই সংগ্রহ করা যায়। শিল্প কারখানায় কোন উৎপাদন ত্রুটি কিংবা ছোটখাটো অসম্পূর্ণতা থাকলে বা নীল জিন্সে সহজেই লুকিয়ে ফেলা সম্ভব।
সাধারণ হালকা রঙের জিন্সগুলোর ছোটখাটো ত্রুটিগুলোও খুব সহজেই লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু নীল জিন্সের কোন ত্রুটি চোখে পড়লে তা নতুন ফ্যাশন হিসেবেও প্রকাশ পায়। মাঝে মাঝে এর কোন ত্রুটি বোঝা যায় না। উৎপাদনকারীদের জন্য এটি একটি বিরাট সম্ভাবনা। এবং এটি বেশিরভাগ জিন্স নীল হওয়ার কারণ।
নীল জিন্সের গ্লোবালাইজেশন এবং ব্র্যান্ডিং
ফ্যাশন শিল্পে বিশ্বব্যাপী আধিপত্য সৃষ্টি করেছে নীল জিন্স। লেডিস, র্যাঙ্গলার ও অন্যান্য বিশ্ববিখ্যাত ব্র্যান্ডগুলো সর্বজনীন প্রতীক হিসেবে নীল জিন্স উৎপাদন করছে এবং বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দিচ্ছে। ধীরে ধীরে, আধুনিক বিশ্বের অন্যতম ফ্যাশন এই জিন্স। নীল রঙের জিন্সের স্থায়িত্ব, রঙের টেকসই এবং ব্যবহার উপযোগী ভাব এর জনপ্রিয়তায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে।
ব্যবহারের ক্ষেত্রে পরিধানকারীর স্বাচ্ছন্দ্যবোধই বিশ্বব্যাপী নীল জিন্সের ব্র্যান্ডিং করে দিয়েছে। এর গঠন, উৎপাদন, যেকোনো পরিধানকারী সাথে সহজেই মানানসই রূপ একে সকলের কাছে প্রিয় এবং পছন্দের পোশাক করে তুলেছে। ভবিষ্যতের প্রজন্মের কাছে এই নীল জিন্স তার আধিপত্য বিস্তার করতে সক্ষম হবে বলে ধারণা করা হয়।
শেষকথা
পৃথিবীতে বেশিরভাগ জিন্স নীল হওয়ার কারণ মানুষের পছন্দ। তাছাড়া এটি যেকোন পরিস্থিতিতে ব্যবহার উপযোগী। এটি খুব সহজেই মানুষের মনোভাব বাহ্যিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং দৈহিক সৌন্দর্যের সাথে মিলে যায়। টেকসই, স্থায়িত্ব এবং ব্যবহার উপযোগী হওয়ার ফলে বর্তমানে পৃথিবীর প্রায় অর্ধেক মানুষই প্যান্ট হিসেবে কমবেশি নীল জিন্স ব্যবহার করে থাকে।

সম্মানিত ভিজিটর আমি আব্দুল কাইয়ুম, পেশায় আমি একজন গণমাধ্যমকর্মী। ব্লগ বলেন আর সংবাদ বলেন এটাই আমার নেশা ও পেশা। এই ব্লগের মাধ্যমে ভিজিটরদের সঠিক তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করাই আমার ছোট্ট প্রয়াস মাত্র।