পাকস্থলীর ক্যান্সার কেন হয়, লক্ষণ ও পাকস্থলী ভালো রাখার উপায়

আমাদের শরীরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ গুলোর একটি হল পাকস্থলী। মূলত খাবার হজম থেকে শুরু করে শরীরে পুষ্টি সরবরাহ পর্যন্ত এর ব্যাপক গুরুত্ব রয়েছে। পাকস্থলী সুস্থ ও কার্যকর থাকলে স্বাভাবিকভাবেই শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায় এবং অনেক রোগ থেকে বাঁচা যায়। কিন্তু বর্তমানে অগোছালো খাদ্যাভ্যাসের কারণে আমাদের মধ্যে অনেকেই পাকস্থলীর ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছে।

তাই পাকস্থলীর ক্যান্সার থেকে রক্ষা পেতে, আমাদের সকলকেই পূর্ব সচেতনতা হিসেবে পাকস্থলীর ক্যান্সার কেন হয়, লক্ষণ ও পাকস্থলী ভালো রাখার উপায় সম্পর্কে জেনে রাখা উচিত। এ সম্পর্কিত বিস্তারিত জেনে নিতে পারবেন এই লেখা থেকে।

পাকস্থলীর ক্যান্সার বলতে কি বুঝায়? Stomach cancer

পাকস্থলীর ক্যান্সার বা গ্যাস্ট্রিক ক্যান্সার হলো পাকস্থলীর মধ্যে ক্যান্সার কোষের অস্বাভাবিক বৃদ্ধিজনিত একটি রোগ। এই ক্যান্সার সাধারণত পাকস্থলীর অঙ্গের অভ্যন্তরীণ প্রাচীর থেকে শুরু হয় এবং ধীরে ধীরে অন্যান্য স্থানে ছড়িয়ে পড়ে। প্রাথমিক অবস্থায় এই ক্যান্সারের লক্ষণগুলো অনেকটা অস্পষ্ট হতে পারে, যার ফলে তা প্রাথমিক পর্যায়ে শনাক্ত করা কঠিন হয়ে পড়ে। 

প্রাথমিক অবস্থায় পাকস্থলীর ক্যান্সার কোন লক্ষণ দেখায় না। আবার অনেক সময় ছোটখাট উপসর্গ দেখায় যা সাধারণ গ্যাস্ট্রিক সমস্যার মতো মনে হতে পারে। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে ক্যান্সার যখন বেশি ছড়িয়ে পড়ে, তখন কিছু লক্ষণ স্পষ্ট হয়ে ওঠে, যেমন – খাদ্য গ্রহণে অসুবিধা, পেটের ব্যথা, ওজন কমে যাওয়া, ক্লান্তি, এবং পেট ফাঁপা ইত্যাদি।

এটি জেনেটিক কারণ, খাদ্যাভ্যাস, হেলিকোব্যাক্টর পাইলোরি ইনফেকশন, ধূমপান এবং অতিরিক্ত অ্যালকোহল সেবন ইত্যাদি কারণে পাকস্থলীর ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ে। পাকস্থলীর ক্যান্সারের চিকিৎসায় সাধারণত সার্জারি, কেমোথেরাপি, এবং রেডিয়েশন থেরাপি প্রয়োগ করা হয়।

পাকস্থলীর ইনফেকশন কি? Stomach infection

পাকস্থলীর ইনফেকশন বলতে পাকস্থলীতে জীবাণুর সংক্রমণকে বোঝানো হয়, যা পাকস্থলীর যন্ত্রণার সৃষ্টি করে। এর জন্য সবচেয়ে সাধারণ জীবাণু হলো হেলিকোব্যাক্টর পাইলোরি (H. pylori)। এই ব্যাকটেরিয়াটি পাকস্থলীর অভ্যন্তরীণ প্রাচীরের উপর বসবাস করে এবং পাকস্থলীর আলসার এবং গ্যাস্ট্রাইটিস সৃষ্টি করতে পারে।

এই ইনফেকশন সাধারণত খাদ্য ও পানীয়ের মাধ্যমে ছড়ায়। দুর্বল স্যানিটেশন ব্যবস্থা এবং অপরিষ্কার পানীয় ব্যবহারের কারণে এই ব্যাকটেরিয়া সহজেই শরীরে প্রবেশ করতে পারে। এছাড়া, সংক্রামিত ব্যক্তির মুখের লালা বা বমির সংস্পর্শেও এই ব্যাকটেরিয়া ছড়াতে পারে।

পাকস্থলীর ক্যান্সার কেন হয়? Stomach cancer

পাকস্থলীর ক্যান্সার নানা কারণে হতে পারে। এর মধ্যে কিছু মূল কারণ নিচে আলোচনা করা হল:

  • জেনেটিক প্রভাব: পরিবারের সদস্যদের মধ্যে পাকস্থলীর ক্যান্সারের ইতিহাস থাকলে, সেই ব্যক্তির পাকস্থলীর ক্যান্সারের ঝুঁকি বেশি থাকে।
  • হেলিকোব্যাক্টর পাইলোরি (H. pylori) ইনফেকশন: এই ব্যাকটেরিয়া পাকস্থলীর আলসার এবং দীর্ঘমেয়াদে ক্যান্সার সৃষ্টি করতে পারে। 
  • খাদ্যাভ্যাস: অত্যধিক লবণাক্ত, ধূম্রজাতীয় এবং প্রক্রিয়াজাত খাবার খাওয়া পাকস্থলীর ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়। ভিটামিন C এবং তাজা ফলমূল ও সবজির অভাবও এই ঝুঁকি বাড়াতে পারে।
  • ধূমপান ও অ্যালকোহল সেবন: দীর্ঘমেয়াদে ধূমপান এবং অতিরিক্ত অ্যালকোহল সেবন পাকস্থলীর ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়।
  • বয়স ও লিঙ্গ: সাধারণত পুরুষদের মধ্যে পাকস্থলীর ক্যান্সারের ঝুঁকি বেশি থাকে এবং এটি বৃদ্ধ বয়সে বেশি দেখা যায়।
  • পুরানো পাকস্থলীর রোগ: দীর্ঘমেয়াদী গ্যাস্ট্রাইটিস বা পাকস্থলীর আলসার পাকস্থলীর ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়াতে পারে।

এছাড়াও আরো বিভিন্ন কারণে এবং স্বাস্থ্যের অযত্নের ফলে এ ধরনের ক্যান্সার হতে পারে।

পাকস্থলী ক্যান্সারের লক্ষণ

পাকস্থলীর ক্যানসারের লক্ষণ

পাকস্থলীর ক্যান্সারের লক্ষণগুলো প্রাথমিক অবস্থায় অস্পষ্ট হতে পারে এবং তা সাধারণ পাকস্থলীর সমস্যার সাথে মিশে যেতে পারে। তবে ক্যান্সার বৃদ্ধি পাওয়ার সাথে সাথে কিছু নির্দিষ্ট লক্ষণ স্পষ্ট হয়ে ওঠে, যেমন:

  • পাকস্থলীর ক্যান্সার হলে খাওয়ার সময় বা পরে পেট ব্যথা হতে পারে এবং খাবার হজমে অসুবিধা দেখা দেয়।
  • অজানা কারণে দ্রুত ওজন কমে যাওয়া পাকস্থলীর ক্যান্সারের একটি লক্ষণ হতে পারে।
  • ক্যান্সারের কারণে শরীরের পুষ্টি শোষণ কমে যেতে পারে, যা ক্লান্তি এবং দুর্বলতা সৃষ্টি করে।
  • পাকস্থলীর ক্যান্সার পেটে ব্যথা এবং ফাঁপা সৃষ্টি করতে পারে। 
  • বিশেষ করে রক্তবমি পাকস্থলীর ক্যান্সারের একটি গুরুতর লক্ষণ।
  • মল ত্যাগে পরিবর্তন, যেমন কালো মল, পাকস্থলীর ক্যান্সারের একটি লক্ষণ হতে পারে।

পাকস্থলীর ক্যান্সার কি ভালো হয়? Stomach cancer

পাকস্থলীর ক্যান্সার পুরোপুরি ভালো হওয়া নির্ভর করে ক্যান্সারের অবস্থান, আকার, এবং ক্যান্সার ছড়িয়ে পড়ার পরিমাণের উপর। প্রাথমিক পর্যায়ে শনাক্ত হলে এবং দ্রুত চিকিৎসা শুরু হলে পাকস্থলীর ক্যান্সার সারানোর সম্ভাবনা থাকে। 

আরও পড়ুন: চোখের বিভিন্ন রোগের কারণ, লক্ষণ ও প্রতিরোধে করনীয়

সাধারণত পাকস্থলীর ক্যান্সারের চিকিৎসায় সার্জারি, কেমোথেরাপি, রেডিয়েশন থেরাপি এবং ইমিউনোথেরাপি প্রয়োগ করা হয়। প্রাথমিক পর্যায়ে ক্যান্সার শনাক্ত হলে সার্জারির মাধ্যমে ক্যান্সার অপসারণ করা যায়। কেমোথেরাপি এবং রেডিয়েশন থেরাপি ক্যান্সার কোষ ধ্বংস করে এবং ক্যান্সার ছড়িয়ে পড়া প্রতিরোধ করে।

তবে, ক্যান্সার যদি মেটাস্ট্যাটিক অবস্থায় পৌঁছে যায়, অর্থাৎ শরীরের অন্যান্য অংশে ছড়িয়ে পড়ে, তবে এটি সম্পূর্ণরূপে সারানো কঠিন হতে পারে। এই ক্ষেত্রে চিকিৎসার উদ্দেশ্য হয় ক্যান্সারের বৃদ্ধি কমানো এবং রোগীর জীবনের গুণমান বাড়ানো।

পাকস্থলী ভালো রাখার উপায় সমূহ

পাকস্থলী সুস্থ রাখার জন্য খাদ্যাভ্যাস, জীবনযাত্রার পরিবর্তন এবং স্বাস্থ্যকর অভ্যাস মেনে চলা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নিম্নলিখিত উপায়গুলো অনুসরণ করলে পাকস্থলীকে সুস্থ রাখা সম্ভব।

(১) সুষম খাদ্যাভ্যাস গ্রহণ করা

সুষম খাদ্যাভ্যাস পাকস্থলীর সুস্থতা বজায় রাখতে সাহায্য করে। পাকস্থলী সুস্থ রাখতে হলে তাজা ফলমূল, শাকসবজি, পুরো শস্য, এবং প্রোটিনসমৃদ্ধ খাবার বেশি করে খাওয়া উচিত।

প্রক্রিয়াজাত খাবার, ফাস্ট ফুড, এবং অতিরিক্ত চর্বি ও লবণযুক্ত খাবার পরিহার করা উচিত। এছাড়া, ভিটামিন C এবং E সমৃদ্ধ খাবার পাকস্থলীর ক্যান্সার প্রতিরোধে সহায়ক।

(২) পর্যাপ্ত পানি পান করা

পর্যাপ্ত পানি পান পাকস্থলীর কার্যকারিতা বজায় রাখে এবং হজম প্রক্রিয়াকে সহজ করে। প্রতিদিন অন্তত ৮ গ্লাস পানি পান করা উচিত। খাবারের সঙ্গে পর্যাপ্ত পানি পান করলে খাবার হজমে সহায়তা করে এবং পাকস্থলীর অম্লতা কমায়।

(৩) ধূমপান ও অ্যালকোহল বর্জন করা

ধূমপান এবং অতিরিক্ত অ্যালকোহল পাকস্থলীর উপর ক্ষতিকারক প্রভাব ফেলে। ধূমপান পাকস্থলীর রক্ত সঞ্চালন কমিয়ে দেয় এবং অম্লতা বাড়ায়, যা আলসার এবং ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়। অ্যালকোহল পাকস্থলীর প্রাচীরকে ক্ষতিগ্রস্ত করে এবং হজম প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করে। তাই, সুস্থ পাকস্থলীর জন্য ধূমপান ও অ্যালকোহল পরিহার করা উচিত।

(৪) নিয়মিত ব্যায়াম করা

নিয়মিত ব্যায়াম পাকস্থলীর হজম প্রক্রিয়া উন্নত করে এবং পেট ফাঁপা, গ্যাস, এবং কোষ্ঠকাঠিন্য কমায়। প্রতিদিন অন্তত ৩০ মিনিট ব্যায়াম করা উচিত। হাঁটাহাঁটি, সাঁতার, যোগ ব্যায়াম, এবং সাইকেল চালানো হজম প্রক্রিয়া উন্নত করে এবং পাকস্থলীর কার্যকারিতা বাড়ায়।

(৫) স্ট্রেস নিয়ন্ত্রণ করা

অতিরিক্ত স্ট্রেস পাকস্থলীর উপর বিরূপ প্রভাব ফেলে এবং হজম প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করে। স্ট্রেস কমাতে মেডিটেশন, যোগ ব্যায়াম, এবং পর্যাপ্ত ঘুম অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সময়মত বিশ্রাম এবং মনের প্রশান্তি বজায় রাখা পাকস্থলীর সুস্থতার জন্য প্রয়োজনীয়।

(৬) সময়মতো খাবার গ্রহণ করা

নিয়মিত সময়ে খাবার খাওয়া পাকস্থলীর সুস্থতা বজায় রাখতে সাহায্য করে। বড় খাবারের পরিবর্তে অল্প অল্প করে বার বার খাওয়া উচিত। খাবার ধীরে ধীরে চিবিয়ে খেলে হজম প্রক্রিয়া সহজ হয় এবং পাকস্থলীর চাপ কমে।

(৭) প্রোবায়োটিক গ্রহণ করা

প্রোবায়োটিকসমৃদ্ধ খাবার পাকস্থলীর সুস্থতা বজায় রাখতে সহায়ক। দই, কেফির, এবং অন্যান্য প্রোবায়োটিকসমৃদ্ধ খাবার পাকস্থলীর ভালো ব্যাকটেরিয়া বৃদ্ধি করে এবং হজম প্রক্রিয়া উন্নত করে।

(৮) পাকস্থলীর অম্লতা নিয়ন্ত্রণ করা

অম্লতা পাকস্থলীর বিভিন্ন সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। অম্লতা কমাতে অতিরিক্ত মশলাযুক্ত এবং তৈলাক্ত খাবার পরিহার করা উচিত। খাবারের পরপর শুয়ে পড়া উচিত নয়, বরং কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করা ভালো। অম্লতা নিয়ন্ত্রণে হালকা খাবার গ্রহণ এবং পর্যাপ্ত পানি পান করা গুরুত্বপূর্ণ।

(৯) নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা বা চেকআপ করানো

নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা পাকস্থলীর যেকোনো সমস্যা দ্রুত শনাক্ত করতে সাহায্য করে। পেটে ব্যথা, গ্যাস, পেট ফাঁপা, বা অন্য কোনো সমস্যা দেখা দিলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া উচিত।

আশা করা যায়, উপরোক্ত বিষয়গুলো মেনে চলতে পারলে, আমাদের পাকস্থলী স্বাস্থ্য ভালো থাকবে।

শেষকথা 

পাকস্থলী সুস্থ রাখা আমাদের দৈনন্দিন জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। সুষম খাদ্যাভ্যাস, পর্যাপ্ত পানি পান, ধূমপান ও অ্যালকোহল বর্জন, নিয়মিত ব্যায়াম, স্ট্রেস নিয়ন্ত্রণ, এবং নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করার মাধ্যমে পাকস্থলীর সুস্থতা বজায় রাখা সম্ভব। তাই আমাদেরকে সঠিক জীবনধারা মেনে চলা উচিত।

Share This Post
Scroll to Top