নিয়মিত মাসিক না হলে করনীয় কি

মধ্যবয়সী নারীদের বৃহৎ একটি অংশ অনিয়মিত মাসিক সমস্যায় ভোগেন। নিয়মিত মাসিক না হওয়া মহিলাদের স্বাস্থ্যের জন্য স্বাভাবিক বিষয় নয়। তাই নিয়মিত মাসিক না হলে করনীয় সম্পর্কে জেনে সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ করুন।

মেয়েদের ক্ষেত্রে বয়ঃসন্ধিকাল থেকে শুরু করে বার্ধক্যের পূর্বে নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত প্রাকৃতিকভাবেই পিরিয়ড হয়। এক্ষেত্রে ২১-৩৫ দিনের মধ্যে মাসিক চক্র সংগঠিত হয়। তবে ২১ দিনের পূর্বে অথবা ৩৫ দিনের পরে পিরিয়ড হওয়াকে অনিয়মিত পিরিয়ড বলা হয়। তাছাড়া পিরিয়ডের সময়কাল তিন দিনের কম এবং সাত দিনের বেশি হলেও তাকে অনিয়মিত পিরিয়ড বলা হয়।

অনিয়মিত মাসিক হওয়ার ক্ষেত্রে বিভিন্ন কারণ থাকতে পারে। তবে এটা স্থায়ী হলে পরবর্তীতে গর্ভধারণের সমস্যা হয়। তাই নিয়মিত মাসিক না হলে করনীয় কি ও নিয়মিত মাসিকের জন্য ঘরোয়া উপায় গুলো জেনে নিন এই আলোচনায়।

অনিয়মিত মাসিক/ পিরিয়ড কিংবা একেবারেই পিরিয়ড বন্ধ হওয়ার মূল কারন হতে পারে পলিসিস্টিক ওভারি সিন্ড্রোমের (POS)। বিশেষ করে, টিনেজার ও মধ্যবয়সী নারীদের অনিয়মিত পিরিয়ডের সমস্যা দেখা দিতে পারে। এর পেছনে অন্যতম কারন হলো হরমোন।

তবে আরও বিভিন্ন কারনে পিরিয়ড নিয়মিত হয় না। যেমন-

  • অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা করা,
  • ক্যাফেইন জাতীয় খাবার (যেমন- অতিরিক্ত কফি) বেশি গ্রহণ করা।
  • খুব বেশি স্ট্রেস নেওয়া।
  • ওজন খুব কম বা বেশি হলে।
  • জরায়ুতে টিউমারের একটি ধরন হলো ফাইব্রয়েডস। এটি পিরিয়ডের স্বাভাবিক চক্রকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে।
  • জন্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহার করলে। যেমন ইনজেকশন, IUD, পিল, প্যাঁচ ইত্যাদির নিয়মিত ব্যবহার করা।
  • ঠাণ্ডা, সর্দি, গলার ইনফেকশননের করনে। অথবা, মনোনিউক্লিওসিস জাতীয় সমস্যায় পিরিয়ড দেরিতে হতে পারে।
  • বড় কোনো স্বাস্থ্য সমস্যা, যেমন থাইরয়েডের সমস্যা বা পলিসিস্টিক ওভারি সিনড্রোমের কারণেও পিরিয়ড দেড়িতে হয়।
  • অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বসবাস করা বা অপরিচ্ছন্ন থাকা।
  • মদ্যপান/ ধূমপান করা ইত্যাদি।
  • শরীরে আয়রনের পর্যাপ্ততা না থাকলেও এ সমস্যা হতে পারে।

এসকল কারনে পিরিয়ড দেড়িতে হওয়া বা পিরিয়ডের সময় পরিবর্তন ইত্যাদি হতে পারে। নিয়মিত মাসিক না হলে করনীয় সম্পর্কে জেনে সঠিক পদক্ষেপ নিন।

অনিয়মিত মাসিক হরমোন জনিত কারনে হতে পারে। এই সমস্যার সমাধানে শরীরে হরমোনের এবং প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদানের মাত্রা ঠিক রাখতে পারলে উপকারিতা পাবেন। এর জন্য নিম্নোক্ত কিছু ঘরোয়া উপাদানের ব্যবহার তুলে ধরা হলো:

(১) সবজি ও ফলের জুস

সবজি ও ফলের জুস প্রয়োজনীয় পুষ্টির চাহিদা পূরন করে দেহে হরমোনের ভারসাম্য রক্ষা করতে কার্যকরী। করলার রস, পুদিনা পাতা, গাজর, আঙ্গুর ও বিভিন্ন ভিটামিন-সি সমৃদ্ধ ফলের জুস নিয়মিত পান করুন। এটি আপনার অনিয়মিত পিরিয়ডের সমস্যা সমাধানে সাহায্য করে।

(২) অ্যালোভেরা

অ্যালোভেরা ত্বকের সৌন্দর্য, চুলের স্বাস্থ্যরক্ষায়, হরমোনের ভারসাম্য রক্ষায় কার্যকরী উপাদান। এটি নিয়মিত মাসিক না হলে করনীয় হিসেবে অন্যতম ব্যবহারযোগ্য উপাদান। নিয়মিত সকালে খালিপেটে অ্যালোভেরা পাতার সাথে অল্প একটু মধুর মিশিয়ে খান। এটি পিরিয়ড নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে থাকে। তবে মাসিক চলাকালীন অবস্থায় এটি না খাওয়াই উচিত।

(৩) জিরা

মাসিক নিয়মিত করতে জিরার উপকারিতা আছে। তাছাড়া এক্ষেত্রে এর কোন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই। এক গ্লাস পানিতে ২ চা চামচ জিরা নিয়ে সারারাত ভিজিয়ে রেখে দিন। সকালে খালি পেটে এই পানির সাথে ভেজানো জিরাগুলোও চিবিয়ে খেয়ে ফেলুন। নিয়মিত এটি পান করলে ভালো ফলাফল পাবেন।

আরও পড়ুন: মাথাব্যথা ও মাইগ্রেনে চিকিৎসায় করণীয়

(৪) আদা

আদা পিরিয়ড সাইকেল রেগুলেশন-এ সাহায্য করে এবং অনিয়মিত পিরিয়ড নিয়মিত করে। ব্যবহারের জন্য ১ কাপ পানিতে ১ চা চামচ পরিমাণ মিহি আদা কুঁচি নিন। তারপর তা ৫-৭ মিনিট গরম পানিতে ফুটান। এবার এর সঙ্গে অল্প পরিমাণে চিনি বা মধু মিশিয়ে নিন। প্রতিদিন খাবার খাওয়ার পর এই পানির মিশ্রনটি তিন বেলা খান। খেয়াল রাখতে হবে, এই পানিটি ভরা পেটে খেতে হবে। কিছু সময়ের মধ্যেই ভালো ফলাফল পাবেন।

(৫) দারুচিনি

দারুচিনি বহুগুণে গুণান্বিত খাবারের মধ্যে অন্যতম। নিয়মিত মাসিক না হলে করনীয় হিসেবে এটি ব্যবহার করতে পারেন। অনিয়মিত পিরিয়ড দূর করতে চা বা লেবুর রসের সাথে দারুচিনি গুড়া করে মিশিয়ে নিয়মিত খেতে পারেন। এটি আপনার পিরিয়ড নিয়মিত করবে। এর পাশাপাশি পিরিয়ডকালীন ব্যথা কমাতেও সাহায্য করে।

(৬) কাঁচা হলুদ

কাঁচা হলুদের ব্যবহারে শরীরের হরমোন জনিত সমস্যা বা হরমোনের ঘাটতি দূর হয়। নিয়মিত ১ কাপ দুধের সাথে এক চা চামচের ৪ ভাগের ১ ভাগ ( এক চতুর্থাংশ) কাঁচা হলুদ ও একটু মধু মিশিয়ে পান করুন। এটি নিয়মিত খেলে কয়েকদিনের মধ্যেই অনিয়মিত মাসিক সমস্যার পরিবর্তন লক্ষ করা যায়।

উপরোক্ত ঘরোয়া উপাদান গুলোর মূল্য তূলনামূলক কম। এবং এসকল উপাদান গুলোই স্বাভাবিক ভাবেই আমাদের রান্নাঘরে পাওয়া যেতে পারে। নিয়মিত মাসিক না হলে করনীয় হিসেবে এই উপায় গুলোর যেকোন একটি নিয়মিত ব্যবহার করুন। তবে দীর্ঘদিন ধরে আপনার সমস্যার কোন উন্নতি না হলে অবশ্যই রেজিস্টার্ড ডাক্তারের পরামর্শ নিন।

নিয়মিত মাসিক না হওয়া নানান বড় সমস্যার লক্ষন হতে পারে। ভবিষ্যতে বড় সমস্যা থেকে রক্ষা পেতে দৈনন্দিন জীবনে নিম্নোক্ত বিষয়গুলো মেনে চললে এর সমাধান পেতে পারেন:

নিয়মিত মাসিক না হলে করনীয়

মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রন: মানসিক চাপ আপনার মাসিক চক্রকেও ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। আপনি যখন মানসিক চাপে থাকেন, তখন আপনার শরীরে কর্টিসল তৈরি হয়, যা আপনার মাসিক চক্রকে ব্যাহত করে। তাই মানসিক চাপমুক্ত জীবনযাপন করার চেষ্টা করুন।

স্বাস্থ্যকর খাবার খান: নিয়মিত মাসিকের জন্য পুষ্টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যেমন- আয়রন, ভিটামিন বি এবং ম্যাগনেসিয়ামের ইত্যাদি। ফল, শাকসবজি, দানাজাতীয় শস্য এবং চর্বিহীন প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার আপনার প্রয়োজনীয় পুষ্টি নিশ্চিত করতে পারে।

আরও পড়ুন: মাথার চুল পড়া বন্ধ করার উপায়

ওজন নিয়ন্ত্রন: অতিরিক্ত ওজন বা কম ওজন দুটি দিকই পিরিয়ডের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে। এর ফলে হরমোনের ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি হয়। যা অনিয়মিত মাসিক হওয়ার হওয়ার কারন। তাই নিয়মিত মাসিক না হলে করনীয় হিসেবে সর্বপ্রথম স্বাস্থ্য সচেতন হতে হবে।

নিয়মিত ব্যায়াম: ব্যায়াম মানসিক চাপ কমাতে, রক্ত সঞ্চালন বাড়াতে এবং ওজনের স্বাস্থ্যকর ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করে। নিয়মিত ব্যায়াম মাসিক চক্রকে প্রভাবিত করে। অতিরিক্ত ব্যায়ামের ফলেও অনিয়মিত পিরিয়ডের সমস্যা দেখা দিতে পারে। তাই হালকা ও নিয়মিত ব্যায়ামের অভ্যাস গড়ে তুলুন।

অন্তর্নিহিত চিকিৎসাঃ- কখনো কখনো বিশেষ কোন রোগের প্রভাবে পিরিয়ড অনিয়মিত হতে পারে। পলিসিস্টিক ওভারি সিন্ড্রোম (PCOS), থাইরয়েড ডিসঅর্ডার এবং ডায়াবেটিস এর মতো চিকিৎসা পরিস্থিতি অনিয়মিত পিরিয়ডের কারন। তাই এসকল রোগের জন্য সঠিক চিকিৎসার ব্যবস্থা নিন।

আকুপাংচারঃ- আকুপাংচার একটি ঐতিহ্যবাহী চীনা চিকিৎসার রূপ। এর মাধ্যমে শরীরের নির্দিষ্ট বিন্দুতে সূঁচ প্রবেশ করানো হয়। এটি মাসিক চক্র নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে আসছে বহুকাল ধরে।

আরো পড়ুন: মুখের ব্রণ ও কালো দাগ দূর করার উপায়

নিয়মিত মাসিক না হলে করনীয় হিসেবে এসকল সাধারন কিছু জীবনব্যবস্থা অনুসরন করুন। এতে আপনার অনিয়মিত পিরিয়ডের সমস্যা বহুলাংশে কাটিয়ে উঠতে পারবেন।

ঠিক সময়ে মাসিক না হওয়ার অন্যতম বড় অর্থ অযাচিত গর্ভবতী হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা। যে সকল নারীদের নিয়মিত পিরিয়ড হয়, তাদের যদি কোন মাসে পিরিয়ড না হয় বা পিরিয়ড চক্র পরিবর্তন হয়, তাহলে তা প্রেগন্যান্সির বড় একটি লক্ষণ হতে পারে।

সাধারণত মাসিক চক্র ২১ থেকে ৩৫/৩৮ দিনের হয়। এই সময়র মধ্যে কোন মহিলার পিরিয়ড না হয়ে থাকলে, এর পেছনে বিভিন্ন কারণ থাকতে পারে। তবে ধরে নেওয়া যায়, তা গর্ভবতী হওয়ার সঙ্কেত দিচ্ছে।

সাধারণত মাসিক চক্র ২১ থেকে ৩৫/৩৮ দিনের হয়। আর সেই সময়র মধ্যে কোনও মহিলার পিরিয়ড না হলে একে গর্ভবতী হওয়ার সঙ্কেত হিসেবে ধরে নেয়া যায়। তবে এটি নিশ্চিত করে বলা কঠিন। এক্ষেত্রে ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে নিশ্চিত হতে পারেন।

অনিয়মিত পিরিয়ড একটি অন্তর্নিহিত স্বাস্থ্য সমস্যার লক্ষণ। আপনি যদি অনিয়মিত মাসিকের সম্মুখীন হন, তাহলে উপরোক্ত নিয়মিত মাসিক না হলে করনীয় গুলো আপনার দৈনন্দিন জীবনে প্রয়োগ করুন। তবে আপনার সমস্যা দীর্ঘস্থায়ী হলে দ্রুত স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারীর সাথে আলোচনা করুন।

Share This Post
Scroll to Top