উচ্চ রক্তচাপ কি, কেন হয়, লক্ষণ এবং উচ্চ রক্তচাপ কমানোর উপায়

বর্তমান সময়ে উচ্চ রক্তচাপ একটি সাধারণ কিন্তু অতি জটিল স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পরিণত হয়েছে। এর ফলে যেকোন সময়েই গুরুতর স্বাস্থ্য সমস্যা যা হৃদরোগ, স্ট্রোক, কিডনি রোগ এবং অন্যান্য জটিল রোগের সৃষ্টি হতে পারে। অনেক সময় এটি তাৎক্ষণিকভাবে একটি মানুষকে মৃত্যুর পর্যায়ে নিয়ে যায়। তাই উচ্চ রক্তচাপ সম্পর্কে এবং এর নিয়ন্ত্রণের উপায় সম্পর্কে সকলেরই জেনে রাখা উচিত।

আজকের এই আলোচনায়, উচ্চ রক্তচাপ কি, উচ্চ রক্তচাপ কেন হয়, উচ্চ রক্তচাপের লক্ষণ এবং উচ্চ রক্তচাপ কমানোর উপায় কি সে সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্যগুলো তুলে ধরা হলো।

উচ্চ রক্তচাপ কি?

উচ্চ রক্তচাপ হলো এমন একটি অবস্থা যেখানে রক্তনালীতে রক্তের চাপ দীর্ঘ সময় ধরে উচ্চ থাকে। এটি হাইপারটেনশন নামেও পরিচিত। এটি একটি সাধারণ কিন্তু গুরুতর স্বাস্থ্য সমস্যা যা হৃদরোগ, স্ট্রোক, কিডনি রোগ এবং অন্যান্য জটিলতা বৃদ্ধির ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়।

রক্তচাপ মূলত দুটি পরিমাপের মাধ্যমে নির্ণয় করা হয়। যথা:

  1. সিস্টোলিক (যখন হৃদয় রক্ত পাম্প করে) এবং 
  2. ডায়াস্টোলিক (যখন হৃদয় শান্ত থাকে)।

সাধারণত আমাদের রক্তচাপ ১২০/৮০ mm Hg এর নিচে থাকে। যদি এটি ১৪০/৯০ mm Hg বা তার বেশি হয়, তাহলে তাকে উচ্চ রক্তচাপ বলা হয়। উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে না থাকলে বিভিন্ন জটিলতার সৃষ্টি হতে পারে। যেমন হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক, এবং কিডনি ফেলিওর। তাই সকল মানুষের জন্যই রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

উচ্চ রক্তচাপ কেন হয়?

উচ্চ রক্তচাপের কারণগুলো সাধারণত দুটি ভাগে বিভক্ত করা হয়। যথা: প্রাথমিক এবং গৌণ কারণ।

(১) প্রাথমিক উচ্চ রক্তচাপ: অধিকাংশ ক্ষেত্রে উচ্চ রক্তচাপের নির্দিষ্ট কোনো কারণ পাওয়া যায় না। এই সমস্যাটি সাধারণত বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে ধীরে ধীরে বিকাশ লাভ করে। প্রাথমিক উচ্চ রক্তচাপের ক্ষেত্রে নিম্নোক্ত কারণগুলো প্রভাব ফেলে থাকে:

  • বংশগত কারণ
  • খাদ্যাভ্যাস (অতিরিক্ত লবণ গ্রহণ)
  • স্থূলতা
  • শারীরিক কার্যকলাপের অভাব
  • ধূমপান ও অ্যালকোহল সেবন
  • মানসিক চাপ

(২) গৌণ উচ্চ রক্তচাপ: কিছু নির্দিষ্ট স্বাস্থ্য সমস্যা বা ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থেকে এই ধরনের উচ্চ রক্তচাপ দেখা দিতে পারে। এর জন্য উল্লেখযোগ্য কারণগুলো হলো:

  • কিডনি রোগ
  • থাইরয়েড সমস্যা
  • অ্যাড্রিনাল গ্রন্থির সমস্যা (যেমন ফিওক্রোমোসাইটোমা)
  • জন্ম নিয়ন্ত্রণ বড়ি
  • কিছু ওষুধ, যেমন ডিকনজেস্টেন্টস

উচ্চ রক্তচাপের জন্য দায়ী কোন গ্রন্থি?

উচ্চ রক্তচাপের জন্য প্রধানত দায়ী হতে পারে অ্যাড্রিনাল গ্রন্থি। আমাদের শরীরে দুইটি অ্যাড্রিনাল গ্রন্থি থাকে, যা কিডনির উপরে অবস্থিত। এই গ্রন্থি থেকে উৎপাদিত কিছু হরমোন, যেমন অ্যাড্রেনালিন এবং অ্যালডোস্টেরন, রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

অ্যাড্রেনালিন হরমোন শরীরে স্ট্রেস রেসপন্স সৃষ্টি করে এবং রক্তচাপ বাড়ায়। অন্যদিকে, অ্যালডোস্টেরন শরীরে সোডিয়াম ও পানির ভারসাম্য নিয়ন্ত্রণ করে, যা রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সহায়ক। অ্যাড্রিনাল গ্রন্থির কোনো অস্বাভাবিকতা (যেমন ফিওক্রোমোসাইটোমা নামক বিরল টিউমার হওয়া), এই হরমোন গুলোর অতিরিক্ত উৎপাদন ঘটায়। ফলে এটি উচ্চ রক্তচাপের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

যেহেতু রক্তচাপ বৃদ্ধির জন্য অ্যাড্রিনাল গ্রন্থি বিশেষভাবে দায়ী হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তাই স্বাস্থ্য চেকআপের সময় অ্যাড্রিনাল গ্রন্থির কার্যক্রমও পরীক্ষা করা প্রয়োজন।

উচ্চ রক্তচাপের লক্ষণ সমূহ

উচ্চ রক্তচাপ বা হাইপারটেনশন, সাধারণত নির্দিষ্ট লক্ষণ ছাড়াই ধীরে ধীরে বিকাশ লাভ করে। মূলত এই কারণেই এটিকে নিঃশব্দ ঘাতক বলা হয়ে থাকে। তবে কিছু ক্ষেত্রে উচ্চ রক্তচাপের লক্ষণগুলো প্রকাশ পেতে দেখা যায়। জটিল সমস্যা থেকে বাঁচতে আমাদেরকে এই লক্ষণগুলো মাথায় রেখে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। তাই এবার রক্তচাপ বৃদ্ধির লক্ষণসমূহ জেনে নেওয়া যাক:

উচ্চ রক্তচাপের লক্ষণ
  • মাথার পিছনের দিকে এবং সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর তীব্র মাথাব্যথা হতে পারে।
  • মাথা ঘোরানো।
  • বুক ধড়ফড় করা।
  • শ্বাসকষ্ট হওয়া।
  • দৃষ্টি ঝাপসা হওয়া।
  • বিরক্তি বা ক্লান্তি।
  • এছাড়াও অনেক সময় উচ্চ রক্তচাপের মাত্রা অনেকাংশে বেড়ে গেলে নাক দিয়ে রক্তপাতও হয়ে থাকে।

উচ্চ রক্তচাপের কোনো লক্ষণ দেখা দিলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরি। 

আরও পড়ুন: চোখের বিভিন্ন রোগের কারণ, লক্ষণ ও প্রতিরোধে করনীয়

রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখার উপায় | উচ্চ রক্তচাপ কমানোর উপায় কি?

উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের জন্য দৈনন্দিন জীবনে সুস্থ জীবনযাপন পদ্ধতি ও কিছু স্বাস্থ্য সচেতনতা মেনে চলা সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এক্ষেত্রে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখার উপায় বা উচ্চ রক্তচাপ কমানোর উপায় হিসেবে উল্লেখযোগ্য বিষয়গুলো নিচে তুলে ধরা হলো:

(১) স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস মেনে চলা

স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের মূল ভিত্তি। এক্ষেত্রে আপনি ড্যাশ (DASH) ডায়েট অনুসরণ করতে পারেন, যা উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সহায়ক। এতে ফল, শাকসবজি, কম ফ্যাটযুক্ত দুগ্ধজাত দ্রব্য, এবং গোটা শস্য অন্তর্ভুক্ত থাকে। ইন্টারনেট থেকে আপনি ড্যাশ (DASH) ডায়েট সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নিতে পারবেন।

খাবারের সাথে যথাসম্ভব কম লবণ গ্রহণ করা উচিত। কারণ অতিরিক্ত সোডিয়াম রক্তচাপ বৃদ্ধি করে। এছাড়াও স্যাচুরেটেড ও ট্রান্স ফ্যাট এড়িয়ে চলা উচিত এবং বেশি প্রোটিন ও ফাইবারযুক্ত খাবার খাওয়া ভালো।

(২) নিয়মিত ব্যায়াম করা

নিয়মিত শারীরিক কার্যকলাপ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিদিন অন্তত ৩০ মিনিট মাঝারি মাত্রার ব্যায়াম, যেমন হাঁটা, সাঁতার, সাইকেল চালানো, রক্তচাপ কমাতে সাহায্য করে। ব্যায়াম হৃদপিণ্ডকে শক্তিশালী করে এবং রক্ত সঞ্চালন উন্নত করে।

(৩) ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা

অতিরিক্ত ওজন উচ্চ রক্তচাপের একটি প্রধান কারণ। তাই ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা অত্যন্ত জরুরি। প্রতিটি ১ কেজি ওজন কমানোর ফলে রক্তচাপ প্রায় ১ mm Hg কমতে পারে। স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস ও নিয়মিত ব্যায়াম ওজন কমাতে সহায়ক।

(৪) ধূমপান ও অ্যালকোহল বর্জন

ধূমপান ও অ্যালকোহল উচ্চ রক্তচাপ বৃদ্ধি করে। ধূমপান রক্তনালী সংকুচিত করে এবং অ্যালকোহল অতিরিক্ত গ্রহণ করলে রক্তচাপ বৃদ্ধি পায়। তাই ধূমপান ও অ্যালকোহল পরিহার করা উচিত।

(৫) স্ট্রেস কমানো

মানসিক চাপ রক্তচাপ বৃদ্ধির একটি প্রধান কারণ। স্ট্রেস কমানোর জন্য মেডিটেশন, যোগব্যায়াম করা এবং পর্যাপ্ত ঘুমাতে পারেন। নিয়মিত রিলাক্সেশন অভ্যাস করলে স্ট্রেস কমে এবং রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে থাকে।

(৬) পর্যাপ্ত পানি পান করা

শরীরে পানির ভারসাম্য রক্ষা করা উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সহায়ক। পর্যাপ্ত পানি পান করলে শরীরের সিস্টেমগুলি সঠিকভাবে কাজ করে এবং রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে থাকে।

(৭) নিয়মিত রক্তচাপ পরীক্ষা ও প্রয়োজনে চিকিৎসা গ্রহণ

উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে হলে নিয়মিত রক্তচাপ পরীক্ষা করা জরুরি। এতে করে রক্তচাপের পরিবর্তন সম্পর্কে জানা যায় এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায়। পাশাপাশি উচ্চ রক্তচাপের জন্য চিকিৎসকের পরামর্শে সঠিক ওষুধ গ্রহণ করাও গুরুত্বপূর্ণ। 

উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে হলে উপরোক্ত পদ্ধতিগুলো মেনে চলা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

তাৎক্ষনিক ভাবে উচ্চ রক্তচাপ কমানোর উপায় | উচ্চ রক্তচাপ কমানোর ঘরোয়া উপায়

তাৎক্ষণিক ভাবে উচ্চ রক্তচাপ কমানোর জন্য চিকিৎসকের সহযোগিতা নেওয়া যায় না। তাই কিছু ঘরোয়া উপায় জেনে রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাৎক্ষনিক ভাবে উচ্চ রক্তচাপ কমানোর উপায় গুলো হলো: 

  1. গভীর শ্বাসপ্রশ্বাস: ধীরে ধীরে গভীর শ্বাস নেওয়া এবং ছাড়া। এটি শ্বাস-প্রশ্বাস নিয়ন্ত্রণ করে এবং স্ট্রেস কমায়।
  2. পানি পান করা: পর্যাপ্ত পানি পান করলে রক্তচাপ সাময়িকভাবে কমতে পারে।
  3. গরম পানিতে পা ভিজানো: পায়ের নিচের অংশ গরম পানিতে ডুবিয়ে রাখলে রক্ত সঞ্চালন উন্নত হয় এবং রক্তচাপ কমতে পারে।
  4. ম্যাসাজ করা: ঘাড় এবং কাঁধের ম্যাসাজ রক্তচাপ কমাতে সাহায্য করতে পারে। বিশেষ করে তেলে ম্যাসাজ করলে।
  5. লেবুর শরবত খাওয়া: লেবুর শরবত তার লেবুর রস খেলে রক্তনালী প্রসারিত হয় এবং রক্তচাপ কমে।

উচ্চ রক্তচাপ কমাতে লেবুর কার্যকারিতা

লেবু উচ্চ রক্তচাপ কমাতে সহায়ক হতে পারে। লেবুতে ভিটামিন সি এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট থাকে, যা রক্তনালীকে নমনীয় করে এবং রক্ত সঞ্চালন বৃদ্ধি করে। লেবুর রস পান করলে বা খাবারের সাথে লেবু যুক্ত করলে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য হতে পারে। উচ্চ রক্তচাপ কমাতে লেবুর ব্যবহার সম্পর্কে নিচে তুলে ধরা হলো:

  • লেবুর রস: প্রতিদিন সকালে এক গ্লাস গরম পানিতে এক চা চামচ লেবুর রস মিশিয়ে খেতে পারেন।
  • লেবুর টুকরো: সালাদ বা খাবারের সাথে লেবুর টুকরো যোগ করে খেতে পারেন।
  • লেবুর শরবত: দিনে কয়েকবার লেবুর শরবত (যেমন লেবু পানি) পান করতে পারেন।

এছাড়াও উচ্চ রক্তচাপের জন্য কোনো নতুন পদ্ধতি গ্রহণের আগে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।

শেষকথা

উচ্চ রক্তচাপ একটি গুরুতর স্বাস্থ্য সমস্যা, যা নিয়ন্ত্রণে না রাখলে হৃদরোগ, স্ট্রোক এবং কিডনি রোগের ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়। ভাই এটা নিয়ন্ত্রণে রাখতে কিছু ঘরোয়া উপায় এবং ডাক্তারের পরামর্শে সুষ্ঠু চিকিৎসা নেওয়া উচিত।

Share This Post
Scroll to Top