হার্টের বিভিন্ন সমস্যা, হার্ট ব্লক হওয়ার লক্ষণ | হার্ট ভালো রাখার উপায় Heart block

হার্টের বিভিন্ন সমস্যা

হার্ট আমাদের শরীরের প্রধান অঙ্গগুলোর একটি। এটি রক্ত সঞ্চালনের মাধ্যমে পুরো শরীরকে অক্সিজেন এবং পুষ্টি সরবরাহ করে। তাই সুস্থতার সাথে জীবন অতিবাহিত করতে, শরীরের এই গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গটির যত্ন নেওয়া অপরিহার্য।

আমাদের হার্টের বিভিন্ন রকমের সমস্যা হতে পারে। যেমন হার্টে ব্লক হওয়া, হার্ট অ্যাটাক এবং অন্যান্য সমস্যা। এগুলোর ক্ষতি থেকে রক্ষা পেতে হার্টের সমস্যার লক্ষণ সমূহ, হার্ট ব্লক হওয়ার লক্ষণ, হার্ট ভালো আছে বুঝার উপায়, হার্ট ভালো রাখার উপায় এবং হার্টের রোগীর খাবার তালিকা সম্পর্কে জেনে রাখা উচিত। এ সম্পর্কিত হার্টের বিভিন্ন সমস্যা, হার্ট ব্লক হওয়ার লক্ষণ। হার্ট ভালো রাখার উপায় বিস্তারিত তথ্য জেনে নিতে পারবেন এই লেখা থেকে।

হার্টের সমস্যার লক্ষণ সমূহ

হার্টের বিভিন্ন সমস্যা বিভিন্ন ধরনের লক্ষণ তৈরি করতে পারে, যার মাধ্যমে হৃদপিণ্ডের অবস্থা সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়।

লক্ষণসমূহ:

  • হাঁটাচলা বা শারীরিক পরিশ্রমের সময় শ্বাসকষ্ট অনুভব করা।
  • অনিয়মিত হৃদস্পন্দন, তীব্র বা দ্রুত হৃদস্পন্দন।
  • পায়ে, পায়ের গোড়ালিতে বা পেটে ফোলা হতে পারে।
  • অস্বাভাবিকভাবে দ্রুত ক্লান্ত হয়ে যাওয়া বা শক্তিহীনতা।
  • মাঝেমধ্যে বুকের মাঝখানে বা বাম পাশে ব্যথা বা চাপ অনুভব করা।
  • মস্তিষ্কে রক্ত সরবরাহ কমে যাওয়ার ফলে মাথা ঘোরা বা অজ্ঞান হয়ে যাওয়া।

হার্ট ব্লক হল যখন হৃদপিণ্ডের ইলেকট্রিকাল সংকেতগুলি যথাযথভাবে পরিচালিত হয় না, যা হৃদপিণ্ডের সঠিক কাজকে ব্যাহত করে। এটি প্রাথমিক, মধ্যম এবং তৃতীয় ডিগ্রি ব্লকের মধ্যে বিভক্ত হয়।

লক্ষণসমূহ:

  • অনিয়মিত হৃদস্পন্দন বা পলকনে সমস্যা হতে পারে।
  • ব্লকের কারণে মস্তিষ্কে রক্ত সরবরাহ কমে যেতে পারে, যার ফলে মাথা ঘোরা বা অজ্ঞান হয়ে যাওয়া ঘটতে পারে।
  • শ্বাস-প্রশ্বাসে সমস্যা হতে পারে, বিশেষ করে শারীরিক পরিশ্রমের সময়।
  • শক্তিহীনতা বা অতিরিক্ত ক্লান্তি অনুভূত হতে পারে, যা দৈনন্দিন কার্যক্রমে বাধা সৃষ্টি করে।
  • তীব্র বা মৃদু বুকের ব্যথা হতে পারে, যা হৃদপিণ্ডের অপ্রতুল রক্ত সরবরাহের লক্ষণ হতে পারে।

হার্ট অ্যাটাক (মায়োকার্ডিয়াল ইনফার্কশন) হলো যখন হৃদপিণ্ডের কোনও অংশে রক্ত সরবরাহ বাধাগ্রস্ত হয়, যা হার্টের পেশীকে ক্ষতিগ্রস্ত করে।

লক্ষণসমূহ:

  • সাধারণত বুকের মাঝখানে বা বাম পাশে তীব্র ব্যথা অনুভূত হয়, যা কয়েক মিনিট বা বেশি সময় ধরে থাকতে পারে।
  • শ্বাস নিতে সমস্যা হতে পারে, বিশেষ করে ব্যথার সাথে।
  • অতিরিক্ত ঘাম হওয়া, বিশেষ করে ঠান্ডা ঘাম।
  • পেটে অস্বস্তি, বমি বা বমি বমি ভাব অনুভূত হতে পারে।
  • বাম হাত, পিঠ বা চোয়ালে ব্যথা ছড়িয়ে যেতে পারে, যা হৃদপিণ্ডের সমস্যার সংকেত হতে পারে।

হার্ট ভালো আছে কিনা তা কিছু সাধারণ লক্ষণ এবং পরীক্ষা দ্বারা বোঝা সম্ভব। যেমন:

  • শ্বাস-প্রশ্বাসের সক্ষমতা: শারীরিক পরিশ্রমের সময় শ্বাস নিতে কোনো সমস্যা না হওয়া।
  • সুস্থ হৃদস্পন্দন: নিয়মিত হৃদস্পন্দন যা প্রতি মিনিটে ৬০-১০০ বার হওয়া উচিত।
  • রক্তচাপ: সঠিক রক্তচাপ যা সাধারণত ১২০/৮০ mmHg এর কাছাকাছি থাকে।
  • শক্তি এবং স্ট্যামিনা: দৈনন্দিন কার্যক্রমে যথেষ্ট শক্তি এবং স্ট্যামিনা থাকা।
  • স্বাস্থ্যকর রক্ত পরীক্ষা: নিয়মিত রক্ত পরীক্ষায় কোনো অস্বাভাবিকতা না থাকা।
  • কোনো ব্যথা বা অস্বস্তি না থাকা: বুক, বাম হাত বা পিঠে কোনো ব্যথা বা অস্বস্তি অনুভূত না হওয়া।

যদি আপনার হার্টের ক্ষেত্রে আপনি স্বাভাবিকভাবে এই সকল বিষয়গুলো বুঝতে পারেন, তাহলে আপনার হার্ট ভালো আছে কিনা জানতে পারবেন।

আরও জানতে: ডায়াবেটিস দ্রুত নিয়ন্ত্রণের উপায়

হৃদপিণ্ড সুস্থ রাখতে এবং হৃদরোগ প্রতিরোধে কিছু কার্যকর উপায় রয়েছে। নিচে হার্ট ভালো রাখার কিছু উপায় আলোচনা করা হলো:

(১) স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস খাওয়া

স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস হার্টের সুস্থতা রক্ষায় অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তাই হার্ট ভালো রাখতে খাদ্য তালিকায় নিম্নলিখিত উপাদানগুলো অন্তর্ভুক্ত করা উচিত:

  • ফল এবং শাকসবজি: প্রতিদিন প্রচুর পরিমাণে তাজা ফল এবং সবুজ শাকসবজি খাওয়া উচিত। এগুলোতে প্রচুর ভিটামিন, মিনারেল, এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট রয়েছে যা হৃদপিণ্ডের জন্য উপকারী।
  • ফল:আপেল, বেরি, কমলা, এবং অন্যান্য তাজা ফল।
  • গোটা শস্য: ব্রাউন রাইস, ওটমিল, এবং গোটা শস্যের পাউরুটি খাওয়া উচিত। এগুলো ফাইবার সমৃদ্ধ যা কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে।
  • মাছ: সপ্তাহে অন্তত দুইবার ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড সমৃদ্ধ মাছ, যেমন স্যামন, ম্যাকেরেল, এবং টুনা খাওয়া উচিত।
  • বাদাম এবং বীজ: বাদাম, আখরোট, এবং ফ্ল্যাক্স সিডে ভালো ফ্যাট থাকে যা হার্টের জন্য উপকারী।
  • অলিভ অয়েল: খাবার প্রস্তুতে এবং সালাদে অলিভ অয়েল ব্যবহার করা উচিত।

(২) পর্যাপ্ত পানি পান

প্রতিদিন পর্যাপ্ত পানি পান করা হার্টের জন্য উপকারী। পানি শরীরকে হাইড্রেট রাখে এবং রক্তের সঞ্চালন ঠিক রাখে। প্রতিদিন ৮-১০ গ্লাস পানি পান করা উচিত।

(৩) ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা

স্বাস্থ্যকর ওজন বজায় রাখা হার্টের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অতিরিক্ত ওজন বা স্থূলতা হৃদপিণ্ডের ওপর অতিরিক্ত চাপ ফেলে এবং হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায়। সুষম খাদ্যাভ্যাস এবং নিয়মিত ব্যায়াম ওজন নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে।

(৪) পর্যাপ্ত ঘুম

প্রতিদিন পর্যাপ্ত ঘুম হার্টের স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য জরুরি। প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য প্রতিদিন ৭-৮ ঘণ্টা ঘুমানো উচিত। পর্যাপ্ত ঘুম হৃদস্পন্দন এবং রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে এবং মানসিক চাপ কমায়।

আরও পড়ুন: চোখের বিভিন্ন রোগের কারণ, লক্ষণ ও প্রতিরোধে করনীয়

(৫) মানসিক চাপ কমানো

মানসিক চাপ হৃদপিণ্ডের স্বাস্থ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। স্ট্রেস কমানোর জন্য বিভিন্ন পদ্ধতি অবলম্বন করা উচিত যেমন ধ্যান, যোগব্যায়াম, এবং পর্যাপ্ত বিশ্রাম। মানসিক চাপ কমানোর জন্য পরিবার এবং বন্ধুদের সাথে সময় কাটানোও সহায়ক।

(৬) নিয়মিত ব্যায়াম করা

নিয়মিত ব্যায়াম হৃদপিণ্ডকে সুস্থ রাখতে সাহায্য করে। প্রতিদিন অন্তত ৩০ মিনিটের জন্য ব্যায়াম করা উচিত। হাঁটা, দৌড়ানো, সাইকেল চালানো, এবং সাঁতার কাটা হৃদপিণ্ডের জন্য ভালো ব্যায়াম। ব্যায়াম হৃদস্পন্দন এবং রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখে এবং ওজন নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে।

(৭) ধূমপান এবং অ্যালকোহল পরিহার

ধূমপান হৃদপিণ্ডের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। এটি আর্টারিগুলোকে সংকীর্ণ করে এবং রক্তচাপ বাড়ায়, যা হৃদরোগের ঝুঁকি বৃদ্ধি করে। তাই ধূমপান সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করা উচিত। এছাড়া, অতিরিক্ত অ্যালকোহল সেবন হার্টের জন্য ক্ষতিকর। সীমিত পরিমাণে অ্যালকোহল গ্রহণ করা উচিত।

(৮) নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করানো

হার্টের স্বাস্থ্য নিয়মিত পরীক্ষা করা উচিত। রক্তচাপ, কোলেস্টেরল, এবং রক্তে সুগারের মাত্রা নিয়মিত পরীক্ষা করা উচিত। প্রয়োজনীয় পরীক্ষা এবং ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ গ্রহণ করা উচিত।

উপরোক্তভাবে আপনি যদি দৈনন্দিন জীবনযাপন পদ্ধতি অনুসরণ করেন, তাহলে হৃদপিন্ডের সুস্থতা আশা করা যায়। এছাড়াও আমাদের ডাক্তারের পরামর্শ মেনে চলতে হবে। পাশাপাশি যারা ইতিমধ্যেই হার্টের বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়েছে, তারা যথাযথ চিকিৎসা নিতে হবে।

হার্টের রোগীদের এবং সকল সাধারণ মানুষদের হার্টের জন্য উপকারী খাবার খাওয়া উচিত। পাশাপাশি হাটের জন্য ক্ষতিকর খাবার গুলো পরিহার করা উচিত। হার্টের বিভিন্ন সমস্যা, হার্ট ব্লক হওয়ার লক্ষণ। হার্ট ভালো রাখার উপায়।

নিচে হার্টের জন্য উপকারী খাবার ও ক্ষতিকর খাবারের তালিকা দেওয়া হলো:

কিছু খাবার হার্টের জন্য বিশেষভাবে উপকারী, যা হৃদপিণ্ডের রোগ প্রতিরোধে সহায়ক। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো:

  1. ব্লুবেরি, স্ট্রবেরি, এবং রাস্পবেরি অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ, যা হৃদপিণ্ডের স্বাস্থ্য রক্ষায় সহায়ক।
  2. সলিউবল ফাইবার সমৃদ্ধ, যা কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণে সহায়ক।
  3. ৭০% বা তার বেশি কোকো সমৃদ্ধ ডার্ক চকোলেট, যা হার্টের জন্য উপকারী।
  4. অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ, যা রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সহায়ক।
  5. মনোআনস্যাচুরেটেড ফ্যাট সমৃদ্ধ, যা হৃদপিণ্ডের জন্য ভালো।
  6. গ্রিন লিফি ভেজিটেবলস, যেমন- পালং শাক এবং অন্যান্য সবুজ শাকসবজি।
  7. হৃদপিণ্ডের জন্য স্বাস্থ্যকর ফ্যাট পেতে অলিভ অয়েল।

কিছু খাবার হার্টের জন্য ক্ষতিকর, যা এড়িয়ে চলা উচিত। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো:

  • ট্রান্স ফ্যাট: প্যাকেটজাত খাবার, বেকড পণ্য এবং ফাস্ট ফুডে পাওয়া যায়, যা কোলেস্টেরল বাড়ায়।
  • অতিরিক্ত লবণ: উচ্চ রক্তচাপের কারণ, যা হৃদপিণ্ডের জন্য ক্ষতিকর।
  • সুগার: অতিরিক্ত চিনিযুক্ত খাবার এবং পানীয় হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায়।
  • প্রসেসড মিট: সসেজ, হ্যাম, এবং বেকন উচ্চ সোডিয়াম এবং চর্বি সমৃদ্ধ।
  • সোডা এবং মিষ্টি পানীয়: উচ্চ সুগার সমৃদ্ধ, যা হৃদপিণ্ডের জন্য ক্ষতিকর।
  • ডিপ ফ্রাইড খাবার: উচ্চ চর্বি এবং ক্যালোরি, যা কোলেস্টেরল বাড়ায়।
  • রেড মিট: অতিরিক্ত রেড মিট গ্রহণ হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায়। 

উপরোক্ত আলোচনা থেকে হার্টের বিভিন্ন সমস্যা, হার্ট ব্লক হওয়ার লক্ষণ ও প্রতিকার এবং হার্ট ভালো রাখার উপায় সম্পর্কে জানতে পারলেন। এগুলো অনুসরণের পাশাপাশি তাৎক্ষণিক কোন সমস্যা দেখা দিলে সরাসরি বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করুন।

Share This Post
Scroll to Top