আলসার কি? কেন হয়, আলসারের লক্ষণ ও মুক্তির উপায় 

স্বাস্থ্য সচেতনতার অভাবে বাংলাদেশের মানুষের মাঝে সবচেয়ে বেশি যেই স্বাস্থ্য সমস্যা গুলো দেখা দেয়, তন্মধ্যে অন্যতম লক্ষণীয় হলো আলসার। সুনিয়ন্ত্রিত খাদ্যাভ্যাস না মানায় আমাদের মধ্যে অধিকাংশ প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষ আলসারের শিকার হচ্ছে। সঠিক জীবন পদ্ধতি অনুসরণের মাধ্যমে এর থেকে পরিত্রান পাওয়া সম্ভব। তবে আলসার খুবই দীর্ঘস্থায়ী হলে, এর থেকে ক্যান্সার পর্যন্ত হতে পারে।

তাই আগে থেকেই সচেতন থাকতে, আলসার কি, আলসার কেন হয়, বিভিন্ন প্রকার আলসারের লক্ষণ, আলসার থেকে মুক্তির উপায় এবং আলসার হলে কি কি খাওয়া যাবেনা সে সম্পর্কে তো বিস্তারিত তথ্য জেনে নিন এখানে।

আলসার হলো এক ধরনের ক্ষত বা ঘা যা সাধারণত পাকস্থলীর ভেতরে, ক্ষুদ্রান্ত্রের প্রাচীরে, অথবা অন্ননালীতে সৃষ্টি হয়। এটি তখন হয় যখন পাকস্থলীর অ্যাসিড বা পাচক রস দ্বারা প্রাচীরের টিস্যু ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আলসার সাধারণত প্রচণ্ড ব্যথা এবং অন্যান্য উপসর্গ সৃষ্টি করে, যা রোগীর দৈনন্দিন জীবনযাত্রার মান কমিয়ে দেয়।

আলসার কেন হয়? আলসার হওয়ার কারণসমূহ

  • হেলিকোব্যাক্টর পাইলোরি (H. pylori) সংক্রমণ: এটি একটি ব্যাকটেরিয়া, যা পাকস্থলীর প্রাচীরে অবস্থান করে এবং প্রাচীরের সুরক্ষা স্তর নষ্ট করে আলসার সৃষ্টি করতে পারে।
  • অ্যাসপিরিন এবং অন্যান্য ননস্টেরয়েডাল অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি ড্রাগস (NSAIDs): এই ধরনের ওষুধ নিয়মিত বা দীর্ঘমেয়াদি ব্যবহারের ফলে আলসার হতে পারে।
  • অতিরিক্ত অ্যাসিড উৎপাদন: স্ট্রেস, ধূমপান, ক্যাফেইন এবং অ্যালকোহল গ্রহণের ফলে পাকস্থলীতে অতিরিক্ত অ্যাসিড উৎপন্ন হতে পারে যা আলসারের কারণ হতে পারে।
  • খাদ্যাভ্যাস এবং জীবনযাত্রা: অতিরিক্ত মশলাদার খাবার, অনিয়মিত খাদ্যাভ্যাস এবং অপর্যাপ্ত ঘুম আলসারের ঝুঁকি বাড়াতে পারে।

আলসার বিভিন্ন ধরনের হতে পারে, যা মূলত ক্ষতের অবস্থান এবং সৃষ্টির কারণের ওপর নির্ভর করে। নিচে আলসারের কয়েকটি সাধারণ প্রকারভেদ উল্লেখ করা হলো:

  1. পেপটিক আলসার: এটি সবচেয়ে সাধারণ আলসার যা পাকস্থলী এবং ক্ষুদ্রান্ত্রের প্রথম অংশ (ডিউডেনাম) এর প্রাচীরে দেখা যায়।
  2. গ্যাস্ট্রিক আলসার: এটি পাকস্থলীর ভেতরের প্রাচীরে সৃষ্টি হয়।
  3. ডুওডেনাল আলসার: এটি ক্ষুদ্রান্ত্রের প্রথম অংশে (ডিউডেনাম) দেখা যায়।
  4. এজোফ্যাজিয়াল আলসার: এটি অন্ননালীর ভেতরের প্রাচীরে সৃষ্টি হয়।
  5. মাউথ আলসার: এটি মুখের ভেতরে বা ঠোঁটে ক্ষত হয়।
  6. গলায় আলসার: এটি গলার ভেতরের প্রাচীরে দেখা যায়।

আলসারের লক্ষণগুলি আলসারের প্রকারভেদ ও অবস্থানের ওপর নির্ভর করে ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে। তবে আলসারের সাধারণ লক্ষণগুলো হলো:

  • তীব্র পেট ব্যথা,
  • পেটে ফাঁপা বা অস্বস্তি,
  • ক্ষুধা কমে যাওয়া,
  • বমি বা বমি ভাব,
  • ওজন কমে যাওয়া,
  • কালো বা রক্তাক্ত মল।

এছাড়াও নিচে বিভিন্ন প্রকার আলসারের লক্ষণ সমূহ তুলে ধরা হলো:

গ্যাস্ট্রিক আলসার পাকস্থলীর প্রাচীরে ক্ষত সৃষ্টি করে। এক্ষেত্রে নিচে উল্লেখিত লক্ষণগুলো প্রকাশ পায়:

  • পেটের উপরের অংশে ব্যথা, বিশেষ করে খাওয়ার পর,
  • বমি বা বমি ভাব,
  • অম্বল বা বুক জ্বালাপোড়া,
  • খাওয়ার পর অস্বস্তি বা ভারী অনুভূতি,
  • ক্ষুধামন্দা,
  • ওজন হ্রাস পাওয়া ইত্যাদি।

গলার আলসার সাধারণত গলার প্রাচীরে ক্ষত সৃষ্টি করে। এক্ষেত্রে নিচে উল্লেখিত লক্ষণগুলো প্রকাশ পায়:

  • গলার ভেতরে ব্যথা বা জ্বালাপোড়া
  • গিলতে কষ্ট হওয়া
  • গলা শুকানো
  • গলা ফোলা বা লাল হওয়া
  • গলা দিয়ে রক্ত বা রক্তমিশ্রিত থুথু আসা
পেপটিক আলসার এর লক্ষণ

পেপটিক আলসার সাধারণত পাকস্থলী বা ডিউডেনামের প্রাচীরে সৃষ্টি হয়। এক্ষেত্রে নিচে উল্লেখিত লক্ষণগুলো প্রকাশ পায়:

  • পেটের মাঝখানে বা উপরের অংশে তীব্র ব্যথা
  • ব্যথা খালি পেটে বেড়ে যাওয়া এবং খাওয়ার পর কমে যাওয়া
  • অম্বল বা বুক জ্বালাপোড়া
  • বমি বা বমি ভাব
  • ক্ষুধামন্দা
  • ওজন কমে যাওয়া

আলসারের কোন লক্ষণ যদি আপনার মাঝে প্রকাশ পায়, তাহলে দ্রুত শনাক্ত করে সঠিক চিকিৎসা নেওয়া জরুরি। সঠিক চিকিৎসা এবং জীবনযাত্রার পরিবর্তনের মাধ্যমে আলসার নিয়ন্ত্রণে রাখা এবং নিরাময় সম্ভব।

আরও জানতে ক্লিক করুণ: জরায়ু ক্যান্সারের লক্ষন, টেস্ট, চিকিৎসা ও প্রতিরোধের উপায়

আলসার থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য তাৎক্ষণিকভাবে উপযুক্ত চিকিৎসা নেওয়ার পাশাপাশি জীবনযাত্রার পরিবর্তন করে স্বাস্থ্য সচেতনতা অবলম্বন করতে হবে। আপনি যদি ইতিমধ্যেই আলসারে আক্রান্ত হয়ে থাকেন, তাহলে নিম্নোক্ত দিক নির্দেশনাগুলো মেনে এর থেকে মুক্তি পাওয়ার চেষ্টা করতে পারেন: 

আলসার নিরাময়ের জন্য চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ গ্রহণ করা অত্যন্ত জরুরি। সাধারণত আনসার এর ক্ষেত্রে নিম্নলিখিত ওষুধগুলো ব্যবহার করা হয়:

প্রোটন পাম্প ইনহিবিটরস (PPI): ওমেপ্রাজল, এসোমেপ্রাজল, ল্যান্সোপ্রাজল ইত্যাদি। এই ওষুধগুলি পাকস্থলীতে অ্যাসিড উৎপাদন কমিয়ে দেয়।

এইচ2 রিসেপ্টর ব্লকার: রেনিটিডিন, ফ্যামোটিডিন ইত্যাদি। এই ওষুধগুলি পাকস্থলীর অ্যাসিড উৎপাদন কমায়।

অ্যান্টাসিড: ম্যাগনেসিয়াম হাইড্রক্সাইড, অ্যালুমিনিয়াম হাইড্রক্সাইড ইত্যাদি। এই ওষুধগুলি পাকস্থলীর অ্যাসিড নিরপেক্ষ করে।

অ্যান্টিবায়োটিক: হেলিকোব্যাক্টর পাইলোরি সংক্রমণের জন্য। অমক্সিসিলিন, ক্ল্যারিথ্রোমাইসিন ইত্যাদি।

আলসার নিরাময়ে স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এক্ষেত্রে অ্যাসিডিক এবং মশলাদার খাবার এড়িয়ে চলতে হবে। যেমন: টমেটো, লেবু, অতিরিক্ত মরিচ ও মসলাদার খাবার ইত্যাদি। পাশাপাশি কম ফ্যাটযুক্ত খাবার গ্রহণ করতে হবে। যেমন- খাবারে কম তেল এবং মশলা ব্যবহার করে তৈরি করা।

এছাড়াও প্রচুর ফল ও শাকসবজি, যেমন আপেল, কলা, গাজর, শাক ইত্যাদি খাওয়া। ওটস, ব্রাউন রাইস, এবং হোল গ্রেইন পাস্তা ইত্যাদি খাওয়া। আর সকল খাবারের পাশাপাশি পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি পান করা।

আলসার নিরাময়ে স্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রার পরিবর্তন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যেমন: ধূমপান এবং অ্যালকোহল বর্জন করা। কারন ধূমপান এবং অ্যালকোহল পাকস্থলীর প্রাচীরে ক্ষতি করে, যা আলসার সৃষ্টির অন্যতম কারণ। 

স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য নিয়মিত ব্যায়াম করাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শারীরিক কার্যকলাপ রক্ত সঞ্চালন বৃদ্ধি করে এবং পাকস্থলীর কার্যকারিতা উন্নত করে। এগুলোর পাশাপাশি দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় মানসিক চাপ কমানোর জন্য মেডিটেশন, যোগব্যায়াম এবং পর্যাপ্ত ঘুমের ব্যবস্থা রাখতে হবে। আর অনিয়মিত খাবার গ্রহণের কারণে অধিকাংশ সময় আমাদের গ্যাস্ট্রিক আলসার হয়ে থাকে। তাই নিয়ম অনুযায়ী সঠিক সময়ে খাবার গ্রহণ করতে হবে।

আলসার নিরাময়ে কিছু প্রাকৃতিক উপাদান অনেক সময় সহায়ক ভূমিকা পালন করে। প্রাকৃতিকভাবে আলসার থেকে মুক্তির জন্য কয়েকটি কার্যকর উপাদান হলো: 

  • আদা পাকস্থলীর অ্যাসিড কমায় এবং হজমশক্তি বাড়ায়।
  • লিকোরিস মূল পাকস্থলীর প্রাচীরের সুরক্ষা করে এবং আলসার নিরাময়ে সহায়ক ভূমিকা রাখে।
  • গ্যাস্ট্রিক আলসারের ক্ষেত্রে অ্যালোভেরা জেল পাকস্থলীর প্রাচীরের সুরক্ষা করে এবং ব্যথা কমায়।

উপরে উল্লেখিত উপায়গুলো অনুসরণ করে আলসার এবং গ্যাস্ট্রিক আলসার থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। তবে আলসার নিরাময়ের জন্য চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে চলা অত্যন্ত জরুরি।

আলসার হলে খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন করা অত্যন্ত জরুরি। এক্ষেত্রে আপনাকে আনসার হলে কিছু খাবার পরিত্যাগ করতে হবে। যেমন:

  • মশলাদার খাবার, যেমন- গোল মরিচ, মরিচের গুঁড়া, কাঁচা মরিচ, সরিষা ও সরিষার তেল ইত্যাদি।
  • ভাজা এবং ফাস্ট ফুড, যেমন- ভাজা পটেটো/ পটেটো চিপস, ফ্রেঞ্চ ফ্রাই, স্ন্যাকস, পিৎজা, বার্গার ইত্যাদি।
  • অ্যাসিডিক খাবার, যেমন- টমেটো এবং টমেটো সস, লেবু, কমলালেবু, এবং অন্যান্য সাইট্রাস ফল, আনারস ইত্যাদি।
  • ক্যাফেইনযুক্ত পানীয়, যেমন- কফি, চা, চকলেটযুক্ত পানীয়, কোলা এবং অন্যান্য ক্যাফেইনযুক্ত সফট ড্রিঙ্কস।
  • অ্যালকোহল, বিয়ার, ওয়াইন এবং যেকোনো মদ্যপান।
  • উচ্চ ফ্যাটযুক্ত খাবার, যেমন- পূর্ণ চর্বিযুক্ত দুগ্ধজাত দ্রব্য, লাল মাংস, প্রসেসড মাংস, মাখন, চিজ ইত্যাদি।
  • প্রসেসড এবং প্যাকেটজাত খাবার।

আলসার সাধারণত চিকিৎসার উপর নির্ভর করে কয়েক সপ্তাহ থেকে কয়েক মাসের মধ্যে সেরে যায়। আলসার গুরুতর হয়ে গেলে কয়েক মাস সময় লাগতে পারে। আলসারের চিকিৎসার মধ্যে ঔষধের পাশাপাশি স্বাস্থ্য সচেতনতা এবং জীবনযাত্রার পরিবর্তনও অন্তর্ভুক্ত হবে।

আরও পড়ুন: হার্টের বিভিন্ন সমস্যা, হার্ট ব্লক হওয়ার লক্ষণ ও প্রতিকার

আলসার থেকে সরাসরি ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনা কম, তবে দীর্ঘস্থায়ী আলসার এবং হেলিকোব্যাক্টর পাইলোরি সংক্রমণ পাকস্থলীতে ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়াতে পারে।

উপরোক্ত আলোচনা থেকে আলসার কি, কেন হয়, আলসারের লক্ষণ ও মুক্তির উপায় সম্পর্কে জানতে পারলেন। দৈনন্দিন জীবনে এগুলো অনুসরণের মাধ্যমে সুস্থ থাকার চেষ্টা করুন। ধন্যবাদ।

Share This Post
Scroll to Top