কিডনির বিভিন্ন রোগ, কারন, লক্ষণ | কিডনি আমাদের দেহের কত গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ তা আমরা সকলেই জানি। সুস্থ সকলকে নিয়ে আমাদের দেশের সামগ্রিক কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি করে। তবে বর্তমানে পৃথিবী ব্যাপী লক্ষ লক্ষ মানুষ কিডনির বিভিন্ন ধরনের রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। এমনকি এর পরিমাণ সমগ্র পৃথিবী জুড়ে শতকরা ২৩ ভাগে পৌঁছেছে।
বাংলাদেশও এই প্রাণঘাতী রোগের করাল থাবার শিকার হচ্ছে দ্রুতগতিতে। স্বাস্থ্য-সচেতনতা সম্পর্কে উপযুক্ত ধারণা না থাকায় কিডনি ৮০% ড্যামেজ হওয়ার আগ পর্যন্ত আমরা এর লক্ষণ বুঝতে পারিনা। তাই আগে থেকেই সচেতন হতে, কিডনির বিভিন্ন রোগ, কারন, লক্ষণ, চেকআপ ও প্রতিকার সম্পর্কে সঠিক তথ্য জেনে নিন এই লেখা থেকে।
কিডনির বিভিন্ন রোগ
কিডনিতে বিভিন্ন ধরনের রোগ হতে পারে। যেমন:
- কিডনির টক্সিন ফিল্টার করার ক্ষমতা হ্রাস পাওয়া বা Interstitial nephritis।
- নেফ্রোটিক সিনড্রোম।
- উচ্চ রক্তচাপজনিত কিডনি রোগ।
- ধীরগতির কিডনি বিকল।
- প্রস্টেটের রোগ।
- ফিউনির ক্যান্সার।
- কিডনি ফেইলর বা কিডনি বিকল।
- প্রস্রাবে বাধাজনিত কারণে কিডনি রোগ।
- ডায়াবেটিসজনিত কিডনি রোগ।
- পাথরজনিত কিডনি রোগ।
- কিডনিতে ইনফেকশন বা প্রস্রাবের ইনফেকশন।
- কিডনিতে সিস্ট বা Polycystic kidney disease।
- কিডনির উপর শরীরের ইমিউন সিস্টেমের প্রভাব বা Lupus nephritis ইত্যাদি।
কিডনিতে কোন রোগ হলে সামগ্রিকভাবে দেহে রক্তশূন্যতা, ক্ষুধামন্দা, হার্ট ফেইলিউর, উচ্চ রক্তচাপ, শরীর ফুলে যাওয়া, শরীরের বর্জ্যগুলো মস্তিষ্কে, হার্টে, হাড়ে জমে যাওয়া ইত্যাদি সমস্যা হয়।
কিডনি রোগের প্রধান কারণ সমূহ
বিভিন্ন পরিসংখ্যান অনুযায়ী জানা যায়, পৃথিবীর প্রায় ৮০ ভাগ কিডনি রোগের কারণ স্পষ্টভাবে জানা সম্ভব হয় না। এছাড়া বাকি যে সকল রোগীদের কিডনি রোগের কারণ নিরীক্ষণ করা গেছে। তার মধ্যে সবচেয়ে বড় কারণগুলো হলো:
- ডায়াবেটিসে আক্রান্ত থাকা।
- হাইপারটেনশন বা উচ্চ রক্তচাপ।
- নেফ্রাটাইসিস।
- গ্লোমেরুলোনেফ্রাইটিস নামক কিডনির প্রদাহ জনিত সমস্যা।
- ইচ্ছামত ঔষধ সেবন করা।
- নেশা জাতীয় দ্রব্য সেবন করা।
- হেপাটাইটিস বি, সি ও স্ট্রেপ্টোকক্কাস এর সংক্রমণ থাকলে।
- অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা কিংবা হঠাৎ ভয় পেলে।
- পানি শূন্যতার কারণে তাৎক্ষণিকভাবেই কিডনি অকেজো হওয়া।
- কিছু কিছু মানুষের বংশগত কারণেও কিডনির রোগ হতে পারে।
এছাড়াও ডায়রিয়া হলে, রক্তক্ষরণ হলে, বমি করলে, ইনফেকশন হলে, সন্তান প্রস্রব পরবর্তী জটিলতায় অতিরিক্ত রক্ষক্ষরণ হলে কিডনির ক্ষতি হয়।
কিডনি রোগের লক্ষণ | কিডনি ড্যামেজের লক্ষণ | কিডনি ইনফেকশনের লক্ষণ
কিডনি যখন উচ্চামায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যায় তখনই এর লক্ষণ আমাদের শরীরে স্পষ্ট হয়। কিন্তু শতকরা ৭০%-৮০% কিডনি রোগী তাদের রোগের প্রাথমিক লক্ষণ বুঝতে পারে না। যতদিন সেই লক্ষণ গুলো বুঝতে পারা যায়, কত দিনে কিডনি গভীরভাবে ড্যামেজ হয়ে যায়।
আরও পড়ুন: ডায়াবেটিস এর লক্ষণ, ক্ষতিকর প্রভাব, দ্রুত নিয়ন্ত্রণের উপায়
সাধারণ কিডনি রোগের উল্লেখযোগ্য লক্ষণগুলো হলো:
- উচ্চ রক্তচাপ।
- ঘুমের সমস্যা।
- ক্ষুধামন্দা।
- কিডনির সমস্যার কারণে হৃদপিণ্ডের আস্তরণের চারপাশে পানি জমা হলে, বুকে ব্যথা হয়।
- ফুসফুসে পানি জমলে শ্বাসকষ্ট হয়।
- বমি বমি ভাব কিংবা বমি হওয়া।
- মানসিক তীক্ষ্ণতা হ্রাস বা মনোযোগের ঘাটতি।
- স্বাভাবিক প্রসাবের পরিমাণের পরিবর্তন।
- ক্লান্তি এবং শারীরিক দুর্বলতা।
- পেশী জটিলতা বা শরীরের বিভিন্ন স্থানে ব্যাথা অনুভূত হওয়া।
- শরীরের বিভিন্ন স্থানে চুলকানি হওয়া এবং চর্মরোগ দেখা দেওয়া।
- শরীরের নিম্নাঙ্গে পানি নেমে যাওয়া। এক্ষেত্রে পা ও গোড়ালি ফুলে যায়।
কিডনির সাধারণ রোগের লক্ষণ প্রকাশের সময়, আমাদের শরীর থেকে প্রসাবের সাথে প্রোটিন বেরিয়ে আসে। কিডনিতে ছোট ছোট মেমব্রেন নষ্ট হয়ে যায়। রক্তনালী থেকে রক্ত, রক্তের পানি, প্লাজমা ইত্যাদি শরীরের বাইরে চলে আসে এবং উচ্চ রক্তচাপের সৃষ্টি হয়।
অন্যদিকে, কিডনি ধীরগতির সাথে ড্যামেজ হতে থাকে। দীর্ঘ সময় পার হওয়ার পর স্থায়ী এবং মারাত্মক কিডনি রোগের সৃষ্টি হয়। কিডনি স্থায়ীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আগে এটি শনাক্ত করা যায় না। স্থায়ীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পর কিডনির কার্যকারিতা শতকরা ২৫-১৫ ভাগে নেমে আসে। এর ফলে শরীরের যাবতীয় বর্জ্যগুলো দেহে বিভিন্ন স্থানে জমা হয়ে ক্যান্সার ও অন্যান্য সমস্যার সৃষ্টি করে।
ঘরোয়াভাবে কিডনি ভালো রাখার উপায়
অধিকাংশ কিডনি রোগের মূল কারণ আমাদের অনিয়ন্ত্রিত জীবন ব্যবস্থা। স্বাস্থ্যকর জীবন যাপন পদ্ধতি অনুসরণ করার মাধ্যমে সুস্থ থাকা সম্ভব। কিডনি ভালো রাখতে সর্বদা নিচের ঘরোয়া উপায় গুলো অনুসরণ করুন:
- তিনি প্রধান কার্যক্রম হচ্ছে আমাদের শরীরের পানি পরিশোধন ও প্রক্রিয়াকরণ। তাই কি দেখে ভালো রাখার সবচেয়ে সহজ উপায় হলো নিয়মিত পরিমাণ মতো পানি পান করা।
- রক্তচাপ ও রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখুন।
- নিয়মিত ব্যায়াম করুন।
- নিয়মিত স্বাস্থ্যকর খাবার খেলে কিডনিসহ শরীরের অন্যান্য অঙ্গগুলো ভালো থাকে। এক্ষেত্রে পটাশিয়ামযুক্ত কলা, কমলালেবু, পালংশাক, ফলমূল ও সবুজ শাকসবজি ইত্যাদি খেতে পারেন।
- অতিরিক্ত মসলাদার, ঝাঁঝালো ও তেল যুক্ত খাবার কিডনির ক্ষতি করে। তাই এগুলো পরিহার করুন।
- অতিরিক্ত ধূমপান ও মদ্যপান করলে কিডনির কার্যক্ষমতা কমতে থাকে। তাই এগুলো পরিহার করুন।
- ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া বিভিন্ন ব্যথার ওষুধ ও অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়া থেকে বিরত থাকুন। এগুলো সরাসরি কিডনি ড্যামেজের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
কিডনি ভালো আছে কিনা বোঝার উপায়
কিডনি সহ শরীরের অন্যান্য অভ্যন্তরীণ অঙ্গগুলো ভালো আছে কিনা তা আমাদের নিজস্ব সময় পর পর চেকআপ করা উচিত। এক্ষেত্রে আপনি নিম্নোক্ত দুইটি চেকআপ করাতে পারেন। যথা:
(1) Albumin-to-creatinine ratio (ACR)
মূলত ACR একটি মূত্র পরীক্ষা পদ্ধতি। এর মাধ্যমে আমাদের দেহের ইউরিনে অ্যালবুমিন ও ক্রিয়েটিনিনের অনুপাত নির্ণয় করা হয়। ACR পরীক্ষা করে ইউরিনে প্রোটিন না পাওয়া যায়, তাহলে বুঝবেন কিডনি ভালো আছে। তবে প্রোটিন পাওয়া গেলে বুঝতে হবে কিডনির কার্যক্ষমতা কমে যাচ্ছে। এভাবে টানা তিন মাস যদি দেখেন ACR টেস্ট এর ফলাফল প্রোটিন পজিটিভ, তাহলে বুঝতে পারবেন কিডনি ভালো নেই।
(2) Glomerular filtration rate (GFR)
ক্রিয়েটিনিন টেস্ট করার পর যদি দেখতে পান তার মাত্রা ঠিক নেই, তাহলে GFR টেস্ট করাতে হবে। তারপর কোন বিশেষজ্ঞ ডাক্তারকে Glomerular filtration rate (GFR) টেস্টের রিপোর্ট দেখালে আপনার কিডনির সমস্যা সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারবেন।
কিডনি টেস্ট নাম লিস্ট
কিডনিতে সমস্যার লক্ষণ প্রকাশ পেলে এবং তখন কোন ডাক্তারের কাছে গেলে, সেই ডাক্তার কিছু টেস্ট করাতে দেয়। রোগীর অবস্থা অনুযায়ী এসকল টেস্ট গুলো ভিন্ন হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো:
- সিবিসি, ইলেক্ট্রোলাইটস, ক্যালসিয়াম, ফসফেট, পিটিএইচ চেকআপ।
- প্রস্রাবের অ্যালবুমিন পরীক্ষা
- ইজিএফআর
- ভিটামিন ডি, রক্তে চিনির মাত্রা, রক্তচাপ, হিমোগ্লোবিন ইত্যাদি চেকআপ।
- ক্রিয়েটিনিন টেস্ট
- ইউরিন রুটিন অ্যান্ড মাইক্রোস্কোপি টেস্ট (R/MI)
- কিডনি আল্ট্রাসাউন্ড (USG) ইত্যাদি
কিডনির পয়েন্ট কত হলে ভালো?
কিডনির পয়েন্ট বলতে আমরা সাধারণত কিডনিতে ক্রিয়েটিনিনের মাত্র কত, তা বুঝিয়ে থাকি। আমাদের দেহের নির্দিষ্ট মাত্রার ক্রিয়েটিনিন থাকা ভালো। বিভিন্ন বয়সে মানবদেহে ক্রিয়েটিনিন এর মাত্রা ভিন্ন হয়। নিচে বয়সভেদে এবং নারী-পুরুষ ভেদে একজন সুস্থ মানুষের দেহে উপযুক্ত ক্রিয়েটেনের মাত্রা তুলে ধরা হলো:
- পুরুষের শরীরে ক্রিয়েটিনিনের স্বাভাবিক মাত্রা ০.৭ থেকে ১.৪ এমজি ডি.এল.।
- নারীদের শরীরে ক্রিয়েটিনিনের স্বাভাবিক মাত্রা ০.৬ থেকে ১.২ এমজি ডি.এল.।
- যাদের ১টি কিডনি নেই, তাদের ক্ষেত্রে ক্রিয়েটিনিনের স্বাভাবিক মাত্রা প্রতি ডেসিলিটার রক্তে ১.৮ মিলিগ্রাম।
- কিশোরদের ক্ষেত্রে প্রতি ডেসিলিটার রক্তে ক্রিয়েটিনিনের স্বাভাবিক মাত্রা হলো ০.৫ থেকে ১.০ মিলিগ্রাম।
- শিশুদের ক্ষেত্রে রক্তে ক্রিয়েটিনিনের মাত্রা ০.৩ থেকে ০.৭ মিলিগ্রাম ডি.এল.।
উপরোক্ত ক্রিয়েটিনিনের মাত্রা অতিক্রম করলেই, তা আমাদের কিডনির জন্য ক্ষতিকর।
কিডনির পয়েন্ট কমানোর উপায়
কিডনির পয়েন্ট কমাতে বা রক্তে ক্রিয়েটিনিনের পয়েন্ট নিয়ন্ত্রণে রাখতে নিচের বিষয়বস্তুগুলো মেনে চলতে হবে:
- বেশি করে ফাইবারযুক্ত খাবার খান।
- দেহ হাইড্রেটেড রাখুন।
- লবণ কম খান।
- প্রোটিন গ্রহণ কমান।
- স্ট্রেন সৃষ্টিকারী ব্যায়াম এড়িয়ে চলুন।
- ক্রিয়েটিনযুক্ত পরিপূরকগুলি এড়িয়ে চলুন।
- সম্ভব হলে নিয়মিত করলা খান।
- ধূমপান ও অ্যালকোহল এড়িয়ে চলুন।
- এবং সম্ভব হলে ক্যামোমাইল চা পান করুন।
শেষকথা
উপরোক্ত আলোচনা থেকে কিডনি সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য জানার পাশাপাশি কিডনির গুরুত্ব উপলব্ধি করা যায়। এর থেকে ধারণা নিয়ে আমাদের সকলেরই উচিত স্বাস্থ্য সম্পর্কে আগে থেকে সচেতন থাকা।
সম্মানিত ভিজিটর আমি আব্দুল কাইয়ুম, পেশায় আমি একজন গণমাধ্যমকর্মী। ব্লগ বলেন আর সংবাদ বলেন এটাই আমার নেশা ও পেশা। এই ব্লগের মাধ্যমে ভিজিটরদের সঠিক তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করাই আমার ছোট্ট প্রয়াস মাত্র।