ডায়াবেটিস এর লক্ষণ, ক্ষতিকর প্রভাব, দ্রুত নিয়ন্ত্রণের উপায় ও খাদ্য তালিকা

বর্তমানে বাংলাদেশের প্রায় ১ কোটিরও বেশি মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। এই সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। আন্তর্জাতিক একটি পরিসংখ্যান থেকে জানা গেছে, প্রতিবছর ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়ে প্রায় ১০ লাখেরও বেশি মানুষের মৃত্যু হয়। তাই ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার প্রাথমিক পর্যায়েই এর সম্পর্কে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।

তাই ডায়াবেটিস এর লক্ষণ, ক্ষতিকর প্রভাব, দ্রুত নিয়ন্ত্রণের উপায় ও খাদ্য তালিকা সম্পর্কে সঠিক ও বিস্তারিত তথ্য জেনে নিন এই লেখা থেকে।

ডায়াবেটিস এর লক্ষণ সমূহ

সাধারণত ডায়াবেটিসের নির্দিষ্ট কোন লক্ষণ নেই। তবে এর ফলে শরীরে বেশ কিছু লক্ষণ প্রকাশ পায় এবং মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। নিচে ডায়াবেটিস এর সূচনাকালে মানুষের দেহে যে সকল লক্ষন প্রকাশ পায়, সেগুলো তুলে ধরা হলো:

  • দুর্বলতা বা ক্লান্তি লাগা ও ঘোর ঘোর ভাব আসা।
  • অস্বাভাবিক বিরক্তি ও মেজাজ খিটখিটে হয়ে ওঠা।
  • ঘনঘন প্রস্রাবের প্রবণতা।
  • তীব্র তৃষ্ণা বা পিপাসা লাগা।
  • ক্ষুধার প্রবণতা বেড়ে যাওয়া।
  • মিষ্টি জাতীয় খাবারের প্রতি আকর্ষণ বেড়ে যাওয়া।
  • কোন কারণ ছাড়াই দ্রুত ওজন অনেক কমে যাওয়া।
  • চোখে ঝাপসা দেখা।
  • সময়মতো খাবার না খেলে রক্তের শর্করা কমে যাওয়া।
  • অপ্রীতিকর গন্ধের অনুভূতি।
  • চামড়ায় শুষ্ক, খসখসে ও চুলকানি ভাব হওয়া।
  • হাতে এবং পায়ে ঝিনঝিন ভাব।
  • শরীরে ক্ষত হলে, তা থেকে সেরে উঠতে দীর্ঘদিন সময় লাগা।

ডায়াবেটিস হলে কি কি সমস্যা হয়

ডায়াবেটিস হলে: 

  • মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়।
  • বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হলে, তা থেকে পরীক্ষা পেতে দীর্ঘ সময় লাগে। 
  • শরীরের অভ্যন্তরীণ নানান ক্ষতি হয়।
  • ব্লাড সুগার বেড়ে রক্তনালীর মারাত্মক ক্ষতি হয় এবং স্নায়ু ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়।
  • ডায়াবেটিসের মাত্রা খুব বেড়ে গেলে দৃষ্টিশক্তিও হারাতে হতে পারে। 
  • এছাড়া অন্ধত্ব, কিডনি নষ্ট হয়ে যাওয়া, হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক ইত্যাদি জটিল মৃত্যুর সুখের পিছনে ডায়াবেটিসের বিশেষ প্রভাব রয়েছে।

ডায়াবেটিস কত হলে বিপদ | ডায়াবেটিস কত হলে মানুষ মারা যায়

খালি পেটে রক্তে সুগারের মাত্রা ৫.৫ পয়েন্টের কাছাকাছি থাকা ভালো। তবে ৫.৫ থেকে ৬.৯ পয়েন্টের মধ্যে থাকলে, তা প্রি-ডায়াবেটিস। এবং ৭ পয়েন্টের উপরে চলে গেলে, তাকে ডায়াবেটিস বলা হয়। 

সাধারণত খাবারের পর অ-ডায়াবেটিস রোগীদের রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা সাময়িকভাবে 7.8 mmol/L (140 mg/dL) বা সামান্য বেশি হতে পারে। তবে ডায়াবেটিসের মাত্রা যদি ১৬.৭ mmol/L এর উপরে চলে যায়, তাহলে রোগীকে সাধারণত কৃত্রিমভাবে ইনসুলিন দেয়ার প্রয়োজন পড়ে। অন্যথায়, মারাত্মক ঝুঁকির সৃষ্টি হতে পারে।

আরও জেনে নিন: হাঁটুর ব্যথা সারানোর ঘরোয়া উপায়

ডায়াবেটিস কত হলে মানুষ মৃত্যুবরণ করবে, তা নির্দিষ্ট ভাবে বলা যায় না। তবে ১৬.৭ mmol/L এর উপরে হলে যেকোন সময় ক্ষতি হতে পারে।

ডায়াবেটিস রোগীর খাদ্য তালিকা

ডায়াবেটিসের রোগীদের একটি সঠিক ও উপযুক্ত খাদ্য তালিকা অনুসরণ করতে হয়। অন্যথায় কঠিন স্বাস্থ্যঝুঁকির সৃষ্টি হতে পারে। একজন ডায়াবেটিক রোগীর খাবার তালিকায় শর্করা, আমিষ, ভিটামিন, খনিজ পদার্থ পানি ও অন্যান্য খাদ্য উপাদানের সঠিক ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে।

তাই নিচের আলোচনা থেকে ডায়াবেটিস রোগীর জন্য একটি উপযুক্ত খাবার তালিকার উপাদানসমূহ সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নিন:

পর্যাপ্ত পানি পান করা

মানব দেহের রক্ত, মাংস, স্নায়ুপিন্ড,হাড়, দাত, অস্থি, মজ্জা, ত্বক সবকিছুর সাথেই পানির গুরুত্ব অপরিসীম। মানুষের দেহের অভ্যন্তরীন যাবতীয় কাজে পানি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। একজন ডায়াবেটিস রোগী প্রতিদিন স্বাভাবিক মাত্রায় পানি পান করবে।

ডায়াবেটিস আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে অনেকেই ঘন ঘন মূত্রত্যাগের ভয়ে পানি পান করতে চায় না। সেক্ষেত্রে জটিলতা আরো বেশি হতে পারে। তবে অধিক ক্যালরিযুক্ত কোমল পানীয় পান করা থেকে বিরত থাকুন।

শর্করা জাতীয় খাবার নির্বাচন

শর্করা এক ধরনের জৈব রাসায়নিক পদার্থ। এর যৌগে কার্বন, হাইড্রোজেন ও অক্সিজেনের সমন্বিত রূপ থাকে। অধিক পরিমাণে শর্করা জাতীয় খাবার খেলে দেহে শর্করার মাত্রার বৃদ্ধি পায়। এর ফলে ডায়াবেটিস রোগীদের রক্তে চিনির পরিমাণও বৃদ্ধি পায়।

সাধারণত সকল প্রকার খাবারেই এই শর্করা পাওয়া যায়। ভাত, রুটি, নুডলস, বিস্কুট, আলু ইত্যাদি শর্করা জাতীয় খাবারের অন্তর্ভুক্ত। একজন ডায়াবেটিক রোগীর জন্য প্রতিদিন ১৮০ গ্রাম কার্বোহাইড্রেট জাতীয় খাবার গ্রহণই যথেষ্ট হবে।

আমিষ জাতীয় খাবার নির্বাচন

প্রাণীজ ও উদ্ভিজ্জ উভয় খাবারেই প্রোটিন পাওয়া যায়। ডায়াবেটিস রোগীদেরকে তূলনামূলক কম ক্যালরিযুক্ত প্রোটিন খাওয়া উচিত। যেমন- ডিম, অল্প চর্বি জাতীয় দুধ, টক দই, দেশজ মাছ ও মুরগি ইত্যাদি। এক্ষেত্রে লাল মাংস ও চর্বিজাতীয় খাবার কম খাওয়া উচিত।

ভিটামিন ও খনিজ পদার্থ যুক্ত খাবার নির্বাচন

বিভিন্ন প্রকার ফলমূল, সবুজ শাক, রঙিন সবজি ইত্যাদি পরিমাণমতো খেলে দেহের ভিটামিন ও খনিজের চাহিদা পূরন হয়ে যায়। পাশাপাশি প্রতিদিন একটি করে মাজারি আকৃতির ফল খেতে পারেন। তবে খেয়াল রাখতে হবে যে খাদ্যক্যালরি এবং ব্লাড সুগার যেন অতিরিক্ত ভিটামিন সেবনের ফলে বৃদ্ধি না পায়।

চর্বি জাতীয় খাবার নির্বাচন

বয়স ও ওজনভেদে ডায়াবেটিস রোগীদের প্রতিদিন ৫০-১৫০ গ্রাম ফ্যাট গ্রহণ করা উচিত। অসম্পৃক্ত চর্বি, যেমন- ওমেগা-৩, সামুদ্রিক মাছের তেল, বাদাম ইত্যাদি মানবদেহের জন্য উপকারী। তবে গরু বা অন্যান্য প্রানীর লাল মাংসের সাথে থাকা প্রোটিন আমাদের দেহের জন্য ক্ষতিকর।

একজন ডায়াবেটিস রোগীর খাবার তালিকায় উপযুক্ত খাবারগুলো পরিমিতভাবে রাখতে পারেন। সাধারণত ডায়াবেটিস রোগীর ক্ষেত্রে মোট ক্যালরির ২০% আমিষ থেকে, ৩০% ফ্যাট থেকে এবং ৫০% শর্করা রাখা অধিক উপকারী।

ডায়াবেটিস রোগীর নিষিদ্ধ খাবার তালিকা

ডায়াবেটিস রোগীদেরকে একটি নির্দিষ্ট সীমার মধ্যেই খাবার তালিকা রাখতে হয়। তবে তাদেরকে অনেককিছু খাওয়া থেকেই বিরত থাকতে হয়। যেমন: সাদা চাল, ব্লেন্ডেড কফি, কলা এবং তরমুজ, কোমল পানীয়, বিস্কুট, চিপ্স, চকলেট, কেক, আইসক্রিম, মাখন, চাইনিজ খাবার, পেস্ট্রি, ফ্রুট স্মুথি, ফলের রস, চর্বিসমৃদ্ধ মাংস ইত্যাদি।

যেহেতু এসকল খাবারে প্রচুর অপকারি খাদ্যক্যালরী থাকে, তাই এগুলো খাওয়া থেকে অবশ্যই বিরত থাকতে হবে।

ডায়াবেটিস হলে কি কি সবজি খাওয়া যাবে না?

সকল প্রকার সবজি ও ফলে একই মাত্রার চিনি বা ফাইবার থাকে না। যেসব সবজিতে ফাইবার বেশি থাকে, সেগুলোর শর্করা ধীরে ধীরে রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা বজায় রাখতে সাহায্য করে। তাই ফাইবার জাতীয় সবজি ও খাবার খাওয়া উচিত। 

স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, যেসকল সবজিতে গ্লাইকোসেমিক ইনডেক্স এর পরিমাণ তুলনামূলক বেশি সেগুলো ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য খাওয়া উচিত নয়। এগুলো আমাদের দেহের ব্লাড সুগার বাড়িয়ে ক্ষতির সম্ভাবনা সৃষ্টি করে। এমন সবজির মধ্যে রয়েছে আলু, ভুট্টা, মিষ্টিকর্ন, মিষ্টি আলু এবং বাটার স্কোয়াশ সবজি। তাই ডায়াবেটিস হলে এসকল সবজি খাওয়া যাবে না।

দ্রুত ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করার উপায় | কি খেলে ডায়াবেটিস দ্রুত কমে?

ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করার উপায়
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করার উপায়

অনেক সময় ডায়াবেটিস রোগীদের হঠাৎ করেই ডায়াবেটিসের মাত্রা অনেকাংশে বৃদ্ধি পায়। তখন তাৎক্ষণিকভাবে ব্যবস্থা না নিলে মারাত্মক ঝকির সৃষ্টি হয়। এক্ষেত্রে দ্রুত গতিতে কাজ করে পাতি লেবু। 

পাতিলেবু ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে অত্যন্ত কার্যকরী উপাদান। এর মধ্যে থাকে অ্যান্টি ব্যাকটেরিয়াল, অ্যান্টিভাইরাল এবং রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতা। এই লেবুর রসে থাকা সালিভা ও হাইড্রোক্লোরিক অ্যাসিডের মিশ্রণ মানুষের হজম শক্তি বাড়াতেও সাহায্য করে। 

ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করতে খাবার খাওয়ার আগে, এক গ্লাস পানিতে পাতিলেবুর রস আর বিট লবণ মিশিয়ে খেয়ে নিন। খাবার খাওয়ার ৪৫ মিনিটের মধ্যে আপনার দেহের রক্তে শর্করার মাত্রা কমাতে সহায়তা করবে। তবে দীর্ঘমেয়াদি ফল পেতে এটি ধারাবাহিকভাবে খেয়ে যেতে হবে।

ডায়াবেটিস চিরতরে নিরাময় হবে?

ব্লাড সুগার আমাদের সকলের দেহেই বিদ্যমান। তবে ডায়াবেটিস রোগীদের ক্ষেত্রে ব্লাড সুগারের মাত্রা অনিয়মিত হারে হ্রাস-বৃদ্ধি হয়। যদিও সঠিক চিকিৎসা ব্যবস্থা এবং খাদ্যাভ্যাস ও জীবন পদ্ধতি অনুশীলনের মাধ্যমে ডায়াবেটিস দীর্ঘস্থায়ীভাবে নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব। তবুও এটি চিরতরে নিষ্ক্রিয় করার চিকিৎসা এখনো তেমন কার্যকরী হয়নি।

শেষকথা 

ডায়াবেটিস সম্পর্কে এই ছিল আজকের সম্পূর্ণ আলোচনা। ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হলে এগুলো অনুশীলনের পাশাপাশি সঠিক চিকিৎসা গ্রহণ করুন। ধন্যবাদ।

Share This Post
Scroll to Top