স্তন ক্যান্সারের লক্ষণ, কারণ, চিকিৎসা ও প্রতিরোধের উপায় | স্তন ক্যান্সার বর্তমান সময়ের অন্যতম বড় নীরব ঘাতক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করছে। সন্তান জন্মদান নিয়ন্ত্রণের জন্য সমাজে ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা হচ্ছে। কিন্তু এর ফলে নারীদের স্তনে জন্ম নিচ্ছে ক্যান্সারের কোষ। আর এটি দীর্ঘস্থায়ী হয়ে গেলে মানুষকে খুব দ্রুতই মৃত্যু পর্যন্ত নিয়ে যেতে পারে।
ক্যান্সারের প্রাথমিক পর্যায়ে এটি শনাক্ত করে চিকিৎসা করতে পারলে মুক্তি সম্ভব। তাই সচেতনতার জন্য স্তন ক্যান্সারের লক্ষণ, কারণ, চিকিৎসা ও প্রতিরোধের উপায়গুলো সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নিন এই লেখা থেকে।
স্তন ক্যান্সার কি? breast cancer
স্তন ক্যান্সার হল এক ধরনের ক্যান্সার যা স্তনের কোষে অস্বাভাবিক বৃদ্ধি ও বিস্তারের মাধ্যমে সৃষ্টি হয়। এটি স্তনের বিভিন্ন অংশে হতে পারে, যেমন দুধের নালি বা স্তনগ্রন্থি। প্রাথমিক লক্ষণগুলির মধ্যে স্তনে গিঁট, আকারে পরিবর্তন, বা ত্বকের অস্বাভাবিকতা থাকতে পারে। দ্রুত চিকিৎসা নিলে সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
স্তন ক্যান্সারের কারণ | স্তন ক্যান্সার কেন হয়?
মানবদেহে স্তন ক্যান্সার বিভিন্ন কারণে হতে পারে। যে সকল নারী পুরুষরা স্তন ক্যান্সার আক্রান্ত হয়েছে, তাদের আক্রান্ত হওয়া একাধিক বিষয়ের উপর নির্ভর করেছিল। স্তন ক্যান্সার হওয়ার প্রধান কারণগুলো নিচে তুলে ধরা হলো:
- জেনেটিক কারণ: পারিবারিক বৈশিষ্ট্য বা জেনেটিক মিউটেশন স্তন ক্যান্সারের প্রধান কারণ হতে পারে। BRCA1 এবং BRCA2 জিনের পরিবর্তন স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়।
- হরমোনাল কারণ: দীর্ঘ সময় ধরে ইস্ট্রোজেন ও প্রোজেস্টেরন হরমোনের উচ্চ মাত্রা স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়। নারীদের দেরিতে মেনোপজ হওয়া বা আগে মাসিক শুরু হওয়াও ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে।
- প্রজনন ও মাতৃত্ব: বয়সের সাথে সাথে সন্তান ধারণের সংখ্যা কম হওয়া বা একেবারেই না হওয়া স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়। প্রথম সন্তান দেরিতে হওয়াও একটি কারণ।
- জীবনধারা ও পরিবেশ: অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, উচ্চ চর্বিযুক্ত খাবার, অ্যালকোহল গ্রহণ এবং ধূমপান স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়। এছাড়া স্থূলতা এবং শারীরিক পরিশ্রমের অভাবও এই ঝুঁকি বৃদ্ধি করে।
- রেডিয়েশন এক্সপোজার: যারা পূর্বে ক্যান্সারের চিকিৎসা হিসাবে রেডিয়েশন থেরাপি পেয়েছে, তাদের স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি বেশি।
- বার্ধক্য: বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়। বিশেষ করে, ৫০ বছরের পর ঝুঁকি উল্লেখযোগ্য হারে বাড়তে থাকে।
- স্তনের দেহবৃত্তীয় পরিবর্তন: অস্বাভাবিক ভাবে স্তন টিস্যুর বৃদ্ধি স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়াতে পারে।
- হরমোন রিপ্লেসমেন্ট থেরাপি: মেনোপজ পরবর্তী হরমোন থেরাপি স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়াতে সক্ষম। বিশেষ করে দীর্ঘ সময় ধরে এ ধরনের থেরাপি ব্যবহার করলে।
- ডায়াবেটিস: ডায়াবেটিস আক্রান্ত ব্যক্তিদের মাঝে স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি বেশি থাকে। বিশেষ করে যারা টাইপ ২ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত আছে, তাদের স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি রয়েছে।
- ডেন্স ব্রেস্ট টিস্যু: যে সকল মানুষের স্তনের টিস্যু ঘন, তাদের মাঝে স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি বেশি।
উপরোক্ত কারণগুলো স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি বৃদ্ধি করে। কিন্তু এগুলো থাকা মানেই যে ক্যান্সারে আক্রান্ত হবেন, তেমনটি নয়। তবুও আমাদের সচেতন থাকতে হবে এবং নিয়মিত চেকআপের মাধ্যমে স্বাস্থ্যের খেয়াল রাখতে হবে।
স্তন ক্যান্সারের লক্ষণ Symptoms of breast cancer
স্তন ক্যান্সারের লক্ষণগুলো নিম্নরূপ:
- স্তনে বা বাহুমূলের নিচে কোনো গিঁট বা মাংসল পিণ্ড অনুভব করা।
- স্তনের আকার বা আকৃতিতে হঠাৎ করে আকস্মিক কোনো পরিবর্তন দেখা দেওয়া।
- স্তনে অস্বাভাবিক চুলকানি বা জ্বালাপোড়া অনুভব করা।
- স্তনের ত্বকে ফোলা, লালচে, গরম বা অস্বাভাবিক ভাব, যেমন- ঝালাপালা হয়ে যাওয়া বা কমলালেবুর ত্বকের মতো হয়ে যাওয়া।
- নিপল ভেতরে ঢুকে যাওয়া কিংবা নিপলে অস্বাভাবিক রঙ বা আকারের পরিবর্তন।
- নিপল থেকে রক্তমিশ্রিত বা স্বচ্ছ স্রাব নির্গত হওয়া।
- বাহুমূলের নিচে বা কাঁধে অস্বাভাবিক ব্যথা বা অস্বস্তি অনুভব করা।
- স্তনের ত্বকে ফুসকুড়ি বা ক্ষত সৃষ্টি হওয়া।
- স্তনে ভারী ভাব বা পূর্ণ অনুভূত হওয়া।
আপনার মাঝে এই সকল লক্ষণগুলো প্রকাশ পেলে এবং স্তন ক্যান্সারের লক্ষণ হিসেবে অনুমান করতে পারলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। কারণ প্রাথমিক অবস্থায় চিকিৎসা নিতে পারলে এর থেকে নিরাময় পাওয়া সম্ভব।
আরও পড়ুন: জরায়ু ক্যান্সারের কারন, লক্ষন, টেস্ট, চিকিৎসা ও প্রতিরোধের উপায়
পুরুষের স্তন ক্যান্সারের লক্ষণ
সাধারণত আমরা ভেবে থাকি যে, স্তন ক্যান্সার শুধুমাত্র নারীদেরই হয়। কিন্তু এটি নারী কিংবা পুরুষ উভয়েরই হতে পারে। পুরুষের স্তন ক্যান্সার হলেও প্রায় অনুরূপ লক্ষণ প্রকাশ পায়।
স্তন ক্যান্সারের চিকিৎসা Breast Cancer Treatment
স্তন ক্যান্সারের চিকিৎসা নির্ভর করে ক্যান্সারের ধরণ, অবস্থান, এবং রোগীর শারীরিক অবস্থার উপর। সাধারণত স্তন ক্যান্সারের জন্য নিম্নলিখিত চিকিৎসা পদ্ধতিগুলো গ্রহণ করা হয়:
(১) সার্জারি (Surgery)
স্তন ক্যান্সারের জন্য সার্জারি হলো সবচেয়ে সাধারণ চিকিৎসা এবং কার্যকর পদ্ধতি। এই চিকিৎসায় আক্রান্ত স্তনের অংশ বা পুরো স্তন অপসারণ করা হয়। সাধারণত এই পদ্ধতিতে ২ ধরনের অপারেশন করা হয়। যথা:
- লাম্পেক্টমি: এক্ষেত্রে ক্যান্সারযুক্ত গিঁট বা টিউমার এবং কিছু আশেপাশের টিস্যু অপসারণ করা হয়।
- মাস্টেক্টমি: এক্ষেত্রে পুরো স্তন অপসারণ করা হয়। কখনও কখনও নিকটস্থ লিম্ফ নোডও অপসারণ করা হয়।
(২) রেডিয়েশন থেরাপি (Radiation Therapy)
এই পদ্ধতিতে ক্যান্সার কোষ ধ্বংস করার জন্য উচ্চমাত্রার রেডিয়েশন ব্যবহার করা হয়। সাধারণত সার্জারি করার পর বাকি ক্যান্সার কোষ ধ্বংস করতে রেডিয়েশন থেরাপি ব্যবহার করা হয়।
(৩) কেমোথেরাপি (Chemotherapy)
কেমোথেরাপিতে ক্যান্সার কোষ ধ্বংস করতে ওষুধ ব্যবহার করা হয়। এটি সার্জারি করার আগে টিউমার ছোট করার জন্য বা পরে শরীরের অন্য কোথাও ছড়িয়ে পড়া ক্যান্সার কোষ ধ্বংস করার জন্য ব্যবহার করা হয়।
(৪) হরমোন থেরাপি (Hormone Therapy)
কিছু স্তন ক্যান্সার ইস্ট্রোজেন ও প্রোজেস্টেরনের উপর নির্ভরশীল। তাই হরমোন থেরাপির মাধ্যমে এসকল হরমোনের প্রভাব বন্ধ করা হয়। সাধারণত এই পদ্ধতিতে ওষুধ বা সার্জারি মাধ্যমে ওভারিজ অপসারণ করা হতে পারে।
(৫) টার্গেটেড থেরাপি (Targeted Therapy)
টার্গেটেড থেরাপিতে শুধুমাত্র নির্দিষ্ট ক্যান্সার কোষকে লক্ষ্য করে ওষুধ ব্যবহার করা হয়। উদাহরণস্বরূপ, HER2-পজিটিভ স্তন ক্যান্সারে টার্গেটেড থেরাপি কার্যকর হয়।
(৬) ইমিউন থেরাপি (Immunotherapy)
এই পদ্ধতিতে শরীরের নিজস্ব রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে ব্যবহার করে ক্যান্সার কোষ ধ্বংস করা হয়। এটি মূলত উন্নত স্তরের দীর্ঘমেয়াদি ভাবে আক্রান্ত ক্যান্সারের জন্য ব্যবহার করা হয়।
(৭) প্যালিয়েটিভ কেয়ার (Palliative Care)
প্যালিয়েটিভ কেয়ার হলো স্তন ক্যান্সারের একটি সহায়ক চিকিৎসা। এই পদ্ধতিতে রোগীর জীবনমান উন্নত করতে সহায়তা করে। ব্যথা নিয়ন্ত্রণ, মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষা এবং অন্যান্য উপসর্গ হ্রাস করতেও এটি গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলে।
স্তন ক্যান্সারের চিকিৎসা নির্ধারণের জন্য, চিকিৎসক রোগীর অবস্থা ও ক্যান্সারের ধরণ অনুযায়ী সঠিক পদ্ধতি নির্ধারণ করবেন। চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী চিকিৎসা গ্রহণ করলেই কার্যকর ফলাফল পাওয়া সম্ভব।
আরও জানতে ক্লিক করুন- নিয়মিত মাসিক না হলে করনীয় কি
স্তন ক্যান্সার হলে কতদিন বাঁচে
স্তন ক্যান্সার হলে কতদিন বাঁচবে, তার কোনো নির্ধারিত সময়কাল নেই। জন্ম ও মৃত্যু মহান আল্লাহ তায়ালার হাতে। স্বাভাবিকভাবে, প্রাথমিক পর্যায়ে সনাক্ত করতে পারলে, ৫ বছরের ৫ বছর বাঁচার প্রায় ৯০% বা তার বেশি। কিন্তু ক্যান্সার ঘনিয়ে আসার পর সনাক্ত করতে পারলে, দীর্ঘদিন বেঁচে থাকার সম্ভাবনা কমে যায়।
স্তন ক্যান্সার প্রতিরোধের উপায়
সাধারণত স্তন ক্যান্সার হওয়ার পর প্রাথমিক পর্যায়ে সনাক্ত করা সম্ভব হয়ে ওঠেনা। আর ক্যান্সার ঘনিয়ে গেলে বেঁচে থাকার সম্ভাবনা কমে যায়। তাই ক্যান্সার আক্রান্ত হওয়ার পর প্রতিকার বা চিকিৎসা করানোর চেয়ে, আক্রান্ত হওয়ার আগে প্রতিরোধ করাই উত্তম। স্তন ক্যান্সার প্রতিরোধ করতে বা এর থেকে মুক্ত থাকার জন্য আমাদের করণীয় গুলো নিচে তুলে ধরা হলো:
- সুষম ও পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ করা। ফল, সবজি, পূর্ণ শস্য, এবং প্রোটিনসমৃদ্ধ খাবার বেশি খাওয়া এবং উচ্চ চর্বিযুক্ত এবং প্রক্রিয়াজাত খাবার এড়িয়ে চলা।
- প্রতিদিন অন্তত ৩০ মিনিট শারীরিক ব্যায়াম করা। নিয়মিত শারীরিক কার্যকলাপ স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি কমায়।
- সন্তানকে স্তন্যপান করানোর মাধ্যমে স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি কমানো যায়।
- স্বাস্থ্যকর ওজন বজায় রাখুন। অতিরিক্ত ওজন এবং স্থূলতা স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়।
- অ্যালকোহল পান থেকে ও ধূমপান থেকে বিরত থাকুন।
- নিয়মিত সমগ্র দেহ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করানো। তারপর সেই পরীক্ষা নিরীক্ষার প্রাপ্ত রিপোর্ট চিকিৎসকের কাছে দেখানো।
- মেনোপজ পরবর্তী সময়ে হরমোন থেরাপি ব্যবহারে সতর্ক থাকুন। কারণ দীর্ঘ সময়ের জন্য হরমোন থেরাপি নিলে স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়তে পারে।
- পরিবারের কেউ আগে স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে থাকলে, সে সম্পর্কে আগে থেকেই সচেতনতা অবলম্বন করুন। কারণ এই রোগটি জেনেটিক ভাবেও ছড়িয়ে থাকে।
শেষকথা
উপরোক্ত আলোচনা থেকে স্তন ক্যান্সারের লক্ষণ, কারণ, চিকিৎসা ও প্রতিরোধের উপায় সম্পর্কে বিস্তারিত জানলেন। এখানে উল্লেখিত প্রতিরোধের উপায় গুলো মেনে চললে স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি কমানো সম্ভব।
সম্মানিত ভিজিটর আমি আব্দুল কাইয়ুম, পেশায় আমি একজন গণমাধ্যমকর্মী। ব্লগ বলেন আর সংবাদ বলেন এটাই আমার নেশা ও পেশা। এই ব্লগের মাধ্যমে ভিজিটরদের সঠিক তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করাই আমার ছোট্ট প্রয়াস মাত্র।