প্রথমেই একটি ইংরেজি প্রবাদের বাংলা দিয়ে শুরু করি, ‘জীবন পুস্পের শয্যা নয়’। তাই কানাডা এসে সেটেল হতে চাইলে একটু কষ্ট করার মন-মানসিকতা এবং ধৈর্য্য থাকতে হবে। (দক্ষ শ্রমিক এবং ছাত্ররা আমার এই লেখার আওতার বাহিরে)। এখানে মূলত ভিজিট ভিসা ও এসাইলাম ক্লেইম নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে, এর বাহিরে কিছু জানতে চাইলে এই লেখা আপনার জন্য নয়, ধন্যবাদ। এই যে কানাডা নিয়ে মিস কনসেপশন ও আপনার Misconceptions about Canada করনীয় নিয়ে একটু নজর দেয়া যেতে পারে…

ভিজিট ভিসা ও এসাইলাম ক্লেইম Canada Visit Visa and Asylum Claim
প্রথম পদ্ধতি: ধরুন আপনি কানাডার ভিজিট ভিসা পেলেন এবং সুন্দরমতো কানাডা পৌঁছালেন, সুন্দর মতো নাও পৌঁছাতে পারেন, এয়ারপোর্টে আপনাকে বাধ্য করে এসাইলাম ক্লেইম নিয়ে নিতে পারে, এটারও ভালো দিক আছে, ঘাবড়াবেন না। কিভাবে? এদেশে পৌঁছানোর এক পর্যায়ে প্রায় ৯৮-৯৯% লোক সোসাল ওয়ার্কসের (OW) কাছে আর্থিক সাহায্য চায়, এবং সেটা পাবার পূর্বশর্ত হলো আপনার একনোলেজমেন্ট স্লিপ থাকতে হবে, মানে IRCC আপনার কেইস প্রাথমিকভাবে গ্রহণ করেছে সেই প্রমাণপত্র। এখন আপনার কেইস যদি এয়ারপোর্টেই নিয়ে নেয় তাহলে আপনি একনোলেজমেন্ট পেপার সাথে সাথে পেয়ে যাবেন, মানে ওরা দিয়ে দিবে। এটা হলে আপনি ৭-১৫ দিনের মধ্যে মানে প্রথম মাস থেকেই সরকারি সাহায্যের আওতায় চলে আসবেন। জীবন কিছুটা হলেও সহজ হবে, অন্তত বাসা ভাড়া নিয়ে টেনশন দূর হবে।
আসুন দ্বিতীয় পদ্ধতিতে: যদি এয়ারপোর্টে আপনার কেইস না নেয় তাহলে সাহায্য পাবার ক্ষেত্রে আপনি এক থেকে দুই মাস পিছিয়ে যাবেন। কিভাবে? আপনি নিজে এবং আত্মীয় স্বজন মিলে খুঁজে উকিল ধরে, উকিলের শিডিউল পেয়ে কেইস সাবমিট করতে অন্তত এক / দেড় মাস লাগবে। সাবমিশনের এক সপ্তাহ পর পাবেন একনোলেজমেন্ট পেপার, তারপর সোসালের আবেদন। এ পর্যায়ে বলে রাখি, রিফিউজি ক্লেইম নিয়ে হীনমন্যতায় ভুগবেন না, কানাডা নিশ্চয়ই একটা প্ল্যান করে লোকজন নিয়ে আসছে এবং সেইজন্যই ওরা এয়ারপোর্টেই বাধ্য করে কেইস নিয়ে নিচ্ছে। সরকারের সদিচ্ছা ছাড়া এটা সম্ভব হতো বলে আমি অন্তত মনে করিনা।
আরও পড়ুন: কানাডা ১০ বছরের ভিজিট ভিসার আবেদন করার নিয়ম
অন্যদিকে, এখন আমরা প্রায়ই শোনতে পাচ্ছি ৭/৮ মাস পর লোকজনের হেয়ারিং হচ্ছে এবং প্রথম হেয়ারিংয়ে (যাকে বলে টেবিল ডিসিশন), মাত্র আধা ঘণ্টায় কেইস পেয়ে যাচ্ছে লোকজন।
তবে উকিল – মুক্তারের ফি নিয়ে বিড়ম্বনার শেষ নেই। এটা নিয়ে আপনাকে অবশ্যই স্টাডি করে আসতে হবে। কেইস তিনভাবে করা যায়,
এক. নিজে-নিজে; দুই. লিগ্যাল এইডের মাধ্যমে (এখন পাওয়া শুধু কষ্ট নয়, দুস্করও বটে এবং ওরা কেইস লিখে দেয়না এবং মিথ্যে কেইস লড়ে না); তিন. ব্যক্তিগতভাবে আইনজীবী ভাড়া করে (এখানে দুই পক্ষ ১. আইনজীবী সহকারী / দোভাষী ২. আইনজীবী)। উকিল/ সহকারী/ দোভাষী নির্বিশেষে আপনাকে (জনপ্রতি) ৩ হাজার থেকে ১০ হাজার ডলার দিতে হবে এবং শুরুতে দিতে হবে ১ থেকে ২ হাজার ডলার। এখানে ভিসা আবেদনের মতো তকদীরে বিশ্বাস করতে হবে, উকিল কেইস পাইয়ে দিবে মনে করে বেশি টাকা খরচের কোন মানে হয়না, বরং নিজে – নিজের পরিবারের সাথে পরামর্শ করে একটি ভালো স্টোরি দাঁড় করিয়ে দিতে পারলে যে কারও মাধ্যমেই কাজ আগানো সম্ভব এবং মজার ব্যাপার হলো আপনি আবেদনের যেকোনো পর্যায়ে উকিল / দোভাষী নিয়োগ দিতে পারবেন।
উকিল কেইস পাইয়ে দিবে মনে করে বেশি টাকা খরচের কোন মানে হয়না, বরং নিজে - নিজের পরিবারের সাথে পরামর্শ করে একটি ভালো স্টোরি দাঁড় করিয়ে দিতে পারলে যে কারও মাধ্যমেই কাজ আগানো সম্ভব।
কানাডায় বাসা Rent a house in Canada
কানাডায় বাসা ভাড়া পাওয়া একটি কঠিন কাজ তবে এখন অনেক সহজ হয়ে গেছে। আগে ক্রেডিট স্কোর ছাড়া বাসা ভাড়া পাওয়া না গেলেও এখন যাচ্ছে – যায়। বিনিময়ে মালিকরা ভাড়া একটু বাড়িয়ে নিয়েছে এই যা! কাঙ্খিত বাসা খুঁজে পাওয়া কষ্ট, সেক্ষেত্রে আপনি কি করবেন? এখানেও সমাধান আছে, অনেক নিউ কামার এখন বাসা খুঁজে দেন এবং বাসা প্রতি ১০০/২০০ ডলার নেন, তাদের সাহায্য নিতে পারেন! এখন কথা হলো আপনি সোসাল থেকে কত পাবেন? সাধারণত একজন সিঙ্গেল আবেদনকারী মাসে ৭৩৩ ডলার পেয়ে থাকেন।
বাসা ভাড়া কত How much is house rent in Canada?
বাসা ভাড়া কেমন? জনপ্রতি ৩৫০ ডলার থেকে ৬০০ ডলার (আমি মূলত টরন্টোর কথা লিখছি)। স্বামী -স্ত্রী দু’জন হলে এবং শেয়ার করার মনমানসিকতা থাকলে ১ হাজার ডলারে একরুমে থাকা সম্ভব। এক বাচ্চাসহ তিন জনের পরিবার হলে; এক বেড রুম, এক লিভিং রুম (বাংলাদেশে আমরা যেটাকে ড্রয়িং রুম বলি), কিচেন- বাথসহ ইউনিট ১২ থেকে ১৪/১৫০০ ডলারে পাওয়া যায়। একরকম ইউনিটে অনেক মালিক, দুই বাচ্চাসহও থাকতে দেন (সব জায়গায় ভালোমন্দ লোক আছেন)। দুই জনের পরিবার হলে ১ হাজার থেকে ১২৫০। ১৬ বছরের নিচে বাচ্চাদের সাময়িক একটি চাইল্ড বেনিফিট দেয় এবং সেটা জনপ্রতি ৭৩৩ এর নিচে হবে।
কানাডায় কি কি সুবিধা আছে What are the benefits in Canada?
১. চিকিৎসা: আপনি ফ্রিতে বিশেষজ্ঞ ডাক্তার দেখাতে পারবেন এবং সেটা বাসার কাছেই তবে অনেক ক্ষেত্রে সেটা সময় সাপেক্ষ, মজার ব্যাপার হলো আপনাকে ঔষধও ফ্রি দেয়া হবে, বললে ফার্মেসী ঔষধ আপনার বাসায় পাঠাবে।
২. যাতায়াত: বাস-ট্রেন ভাড়া প্রতি দুই ঘন্টায় ৩.৩০ ডলার হলেও, আপনি ফেয়ার পাসের আওতায় সেটা ২.১০ ডলারে নামিয়ে আনতে পারবেন (এক টিকেটেই বাস ও সাবওয়ে ট্রেন সুবিধা)।
৩. ফুড ব্যাংক: সপ্তাহে একদিন আপনি ফুড ব্যাংক থেকে নির্দিষ্ট পরিমাণ খাবার আনতে পারবেন। মুসলমানদের জন্য আরেকটি আলাদা ফুড ব্যাংক আছে, সেখান থেকে আপনি মাসে একদিন ব্যাপক দামী পণ্য পাবেন।
৪. চাকুরীর প্রস্তুতি ও ট্রেনিং: আপনি চাইলে যেকোনো ছোট কোর্স করতে পারবেন ফ্রিতে। সেক্ষেত্রে আপনাকে এমপ্লয়মেন্ট এলাউন্স দেয়া হবে। ইএসএল (ইংরেজি শিখা) ক্লাসে ভর্তি হলে মাসে ১০০ ডলার গাড়ি ভাড়া পাবেন তিন মাস, অনলাইন ক্লাসে ভর্তি হলে ৩৪০ ডলার পাবেন ল্যাপটপ কেনার জন্য, সাথে প্রতি মাসে ৬৫ ডলার ইন্টারনেট বিল।
৫. স্থায়ী রোগ: আপনার কোনো স্থায়ী রোগ বিদ্যমান থাকলে আপনি ডাক্তারের মাধ্যমে ফরম পূরণ করে দিলে আপনাকে মাসে ৩০ থেকে ২০০ ডলার এক্সট্রা বেনিফিট দিবে। এইসব ফরম পূরণে অবশ্য ডাক্তাররা ২০ থেকে ২৫ ডলার নেয়। আপনি নতুন করে ব্যাংক একাউন্ট করলে, ব্যাংকও আপনাকে ৩০০_৩৫০ ডলার ওয়েলকাম বোনাস দিতে পারে।
৬. বাচ্চাদের স্কুল: ফুল ফ্রি, সাথে নির্দিষ্ট বয়সের বাচ্চাদের ফ্রি ল্যাপটপ প্রদান করা হয়।
এতো এতো সুবিধা দেয়ার পেছনে একটাই উদ্দেশ্য- আপনি নিজেকে চাকুরী তথা কাজের জন্য প্রস্তুত করে তুলবেন, এবং সর্বাবস্থায় আইন মেনে চলবেন। তবে কোনো বেনিফিটই এক বছরের বেশি সময়ের জন্য প্রযোজ্য নয়। এই সময়ের মধ্যেই হয় আপনি কাজে যোগ দেবেন নাহয়, আপনার কেইসের সিদ্ধান্ত পাবেন; একটা না একটা কিছু হবেই, করতেই হবে।
কানাডায় কাজ পাওয়া Getting a job in Canada
আসুন কাজের আলোচনা করি: আমি নিজেই সাত মাস থেকে বেকার কিন্তু হতাশ হইনি, টুকটাক অনলাইনে কাজ করি এবং খেয়ে পরে বেঁচে আছি তার কারণ ইংরেজি ভাষা জানা ছাড়া আমার কোনো বিকল্প দক্ষতা নেই। এমনকি ড্রাইভিংটাও বাংলাদেশ থেকে শিখে আসিনি! ৫ মাস আগে জি ওয়ান পাশ করেছি এবং আরও তিন মাস পর জি টু পরীক্ষায় অবতীর্ণ হবো। যদি ড্রাইভিংটাই জানতাম এবং জি লাইসেন্স নিতে পারতাম তাহলে দিনে কমপক্ষে ১০০ ডলার রুজি করতে পারতাম, যাইহোক! কানাডায় কাজ পাবার প্রথম শর্তই হলো দক্ষতা। এখানে সিকিউরিটি গার্ডের চাকুরী করতেই পরীক্ষা দিয়ে লাইসেন্স নেয়া লাগে, ড্রাইভিং লাইসেন্স লাগে এবং CPR Course করা লাগে।
দ্বিতীয় শর্ত নেপোটিজম, এক্ষেত্রে বাংলাদেশ – কানাডা সেইম – সেইম। বলা হয়ে থাকে, কানাডায় ৮০ ভাগ কাজের বিজ্ঞাপন প্রকাশ পায়না, মামা – খালুর মাধ্যমেই নিয়োগ দেয়া হয়, এক্ষেত্রেও আপনার মোটামুটি দক্ষতা লাগবেই।
কাজ পাননা, কাজ পাননা, আপনি কি জানেন? আপনার কি দক্ষতা আছে যে, আপনি কাজ পাবেন; আমার নিজেরই কোনো দক্ষতা খুঁজে পাইনা! পরিচিত এক ভাই, আগে মধ্যপ্রাচ্যে ছিলেন, খুব ভালো মিষ্টি বানাতে পারেন, তিনি কাজ খুঁজতে হয়নি, প্রতিষ্ঠিত দোকানীরা উনাকে অর্ডার দেয়, উনি বাসায় বানিয়েই ওদেরকে সাপ্লাই দেন। আমার এক বোন জামাই, ভালো ইলেক্ট্রিক কাজ জানেন, তিনিও আগে মধ্যপ্রাচ্যে ছিলেন, সপ্তাহে ৭ দিনই কাজ করাতে চায় ঠিকাদার, উনি জোর করে এক/দুই দিন বাদ দেন এবং রোজও খুব ভালো। আরেক ছোট ভাই মধ্যপ্রাচ্যে রিনোভেশনের কাজ করতো, এখানেও করে, মাসে তার অন্তত ১৫ দিন কাজ আছে। অনেকেই সপ্তাহে এক / দুই দিন রিনোভেশনের কাজ, ইলেক্ট্রিকের কাজ, রংয়ের কাজ করেন, কেউ কেউ সাইকেল চালিয়ে উবার করেন।
অনেকেই কাজ যে করেন, সেটা লুকিয়ে রাখেন, বলতে চাননা! আমার এক বন্ধু, উনার ওয়াইফ ভালো রান্না জানেন, ফেসবুকে পেইজ খুলেছেন, খাবার রান্না করে দেন অর্ডার অনুযায়ী, দিনে অন্তত ১০০ ডলারের অর্ডার আসে, তাও কম কিসে! যাই হোক, আমি অন্তত হতাশ হবার কিছু দেখি না, কানাডা সরকার অন্তত খেয়ে পরে বেঁচে থাকার সুযোগ দেয়, হয়তো সেই টাকায় বিলাসিতা হয়না কিন্তু মান গেল, মান গেল; জাত গেল, জাত গেল; এমন হাহাকারের মানে হয়না!
শেষ কথা
একটু কষ্ট, একটু মানিয়ে নেয়া, একটু বুদ্ধি খাঁটিয়ে চলা, একটু মিতব্যয়ী হওয়া, সঠিক মানুষের খোঁজ পাওয়া (বাসা ও উকিলের ব্যাপারে); এইতো! কানাডার জীবন এতো কঠিন নয়, দয়া করে নেগেটিভ হাইপ তুলা থেকে বিরত থাকুন। এই যে কানাডা নিয়ে যে মিস কনসেপশন কিছুটা হলেও আপনার করনীয় সর্ম্পকে বুঝতে সক্ষম হয়েছে।

কানাডা প্রবাসী ও কমিউনিটি নেতা

সম্মানিত ভিজিটর আমি আব্দুল কাইয়ুম, পেশায় আমি একজন গণমাধ্যমকর্মী। ব্লগ বলেন আর সংবাদ বলেন এটাই আমার নেশা ও পেশা। এই ব্লগের মাধ্যমে ভিজিটরদের সঠিক তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করাই আমার ছোট্ট প্রয়াস মাত্র।