এম পক্স, যা পূর্বে মাঙ্কিপক্স নামে পরিচিত ছিল। এটা একটি বিরল কিন্তু সংক্রামক ভাইরাসজনিত রোগ— যা পশু থেকে মানুষের মধ্যে ছড়াতে পারে। রোগটি প্রথম সনাক্ত করা হয় ১৯৫৮ সালে, যখন গবেষণাগারে বন্দি কিছু বানরের মধ্যে এর প্রাদুর্ভাব দেখা যায়। যার কারণে প্রথমে এটিকে মাঙ্কিপক্স নামে অভিহিত করা হয়। তবে, এই ভাইরাসটির প্রকৃত সংক্রমণের উৎস প্রধানত বিভিন্ন বন্যপ্রাণী, বিশেষ করে কাঠবিড়ালি ও ইঁদুরের মতো স্তন্যপায়ী প্রাণী।
এই রোগটির প্রাদুর্ভাব যদিও সাধারণত পশ্চিম ও মধ্য আফ্রিকায় সীমাবদ্ধ ছিল। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিশ্বের অন্যান্য অংশেও এটা ছড়িয়ে পড়েছে। এর ফলে, এম পক্স এখন একটি বৈশ্বিক স্বাস্থ্যের উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এম পক্সের সংক্রমণ সাধারণত মানুষের মধ্যে সরাসরি সংস্পর্শের মাধ্যমে ছড়ায় এবং এটি প্রচলিত রোগের সাধারণ লক্ষণ যেমন জ্বর, মাথাব্যথা, মাংসপেশীর ব্যথা এবং ক্লান্তি থেকে শুরু করে ত্বকে ফুসকুড়ি ও ক্ষত সৃষ্টি করতে পারে। যদিও এটি একটি স্বল্প-মেয়াদী এবং কম প্রাণঘাতী রোগ। তবে এর দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার ক্ষমতা এবং দীর্ঘমেয়াদী স্বাস্থ্যগত প্রভাবের কারণে এটি প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে বিশেষ গুরুত্ব পাওয়া উচিত। Mpox
বর্তমান বিশ্বে সংক্রামক রোগের প্রাদুর্ভাব এবং মহামারির সম্ভাবনা যে পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছে, তাতে এম পক্সের মতো নতুন এবং পুনরায় উদ্ভূত হওয়া রোগগুলি নিয়ে সচেতনতা বাড়ানো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই আর্টিকেলের উদ্দেশ্য হলো এম পক্সের ইতিহাস, সংক্রমণ, চিকিৎসা, বাংলাদেশের এর প্রভাব এবং প্রতিরোধের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে বিস্তারিত আলোকপাত করা। যা জনসচেতনতা বৃদ্ধিতে সহায়ক হবে এবং এ রোগটির ভবিষ্যত পরিস্থিতি সম্পর্কে সম্যক ধারণা দেবে।
এম পক্সের ইতিহাস ও উৎপত্তি Mpox
এম পক্স, যা পূর্বে মাঙ্কিপক্স নামে পরিচিত ছিল। এটা প্রথম সনাক্ত করা হয় ১৯৫৮ সালে। তখন ডেনমার্কের একটি গবেষণাগারে বন্দি কিছু বানরের মধ্যে ফুসকুড়ি জাতীয় এক ধরনের রোগ দেখা দেয়। এটি ছিল প্রথম মাঙ্কিপক্সের সনাক্তকরণের ঘটনা এবং সেই থেকেই এর নামকরণ করা হয় ‘মাঙ্কিপক্স।’
উৎপত্তি এবং প্রাথমিক গবেষণা: মাঙ্কিপক্স মূলত পশ্চিম এবং মধ্য আফ্রিকার গ্রীষ্মমণ্ডলীয় বনাঞ্চলগুলোতে প্রাচীনকাল থেকে বিদ্যমান। এই অঞ্চলে, বিভিন্ন বন্যপ্রাণী ভাইরাসটির বাহক হিসেবে কাজ করে এবং মাঝে মাঝে প্রাণী থেকে মানুষের মধ্যে এই ভাইরাসটি সংক্রমিত হয়। প্রথম মানব মাঙ্কিপক্স সংক্রমণ সনাক্ত করা হয় ১৯৭০ সালে, কঙ্গো গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রে (তৎকালীন জাইরে) একটি শিশুর মধ্যে। এ ঘটনার পর থেকে, বিশেষত আফ্রিকার প্রত্যন্ত অঞ্চলে রোগটি মাঝে মাঝে প্রাদুর্ভাব দেখা দিতে থাকে।
আরও পড়ুন: স্তন ক্যান্সারের লক্ষণ, কারণ, চিকিৎসা ও প্রতিরোধের উপায়
মাঙ্কিপক্সের প্রাদুর্ভাবের উপর গবেষণা করতে গিয়ে বিজ্ঞানীরা লক্ষ্য করেন যে এটি পক্সভিরিডি পরিবারের ভাইরাস দ্বারা সৃষ্ট, যার মধ্যে স্মলপক্স ভাইরাসও অন্তর্ভুক্ত। তবে, স্মলপক্সের তুলনায় মাঙ্কিপক্স কম মারাত্মক এবং এর সংক্রমণ হারও তুলনামূলকভাবে কম।
আফ্রিকা এবং বাইরের প্রাদুর্ভাব: ১৯৭০ থেকে ১৯৮৬ সালের মধ্যে, কঙ্গোতে ৪০০ টিরও বেশি মানব মাঙ্কিপক্স সংক্রমণের ঘটনা নথিভুক্ত করা হয়। তবে ২০০৩ সালে, এই রোগটি প্রথমবারের মতো আফ্রিকার বাইরে প্রাদুর্ভাব ঘটে, যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গাম্বিয়ান বিশাল ইঁদুরের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছিল। এ ঘটনা বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্য সংস্থাগুলিকে রোগটির উপর আরও গভীরভাবে নজর দিতে উদ্বুদ্ধ করে।
মাঙ্কিপক্স কেন ‘এম পক্স’ হলো? Mpox
প্রাথমিকভাবে, “মাঙ্কিপক্স” নামকরণটি এ রোগের প্রকৃত বাহক সম্পর্কে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেছিল এবং এটি নির্দিষ্ট একটি প্রাণীর প্রতি মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করে ফেলেছিল। এছাড়া, কিছু লোকের মধ্যে এই নামটি বৈষম্য এবং ভুল ধারণা তৈরি করতে পারে এমন আশঙ্কা ছিল। এই কারণে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) ২০২২ সালে এই রোগটির নাম পরিবর্তন করে “এম পক্স” করার সিদ্ধান্ত নেয়। এটি নামকরণে বৈজ্ঞানিক নিরপেক্ষতা এবং রোগটি সম্পর্কে যথাযথ ধারণা প্রদানে সহায়ক হবে বলে মনে করা হয়।
এম পক্স কীভাবে সংক্রামিত হয়?
প্রাণীর সংস্পর্শ: এম পক্স ভাইরাস প্রধানত বন্যপ্রাণীর মাধ্যমে ছড়ায়। সংক্রমণের অন্যতম প্রধান উৎস হলো সংক্রমিত প্রাণীর রক্ত, শারীরিক তরল, বা ত্বকের ক্ষতের সাথে সরাসরি সংস্পর্শ। উদাহরণস্বরূপ, আফ্রিকান কাঠবিড়ালি, গাম্বিয়ান বিশাল ইঁদুর, এবং অন্যান্য রডেন্টস (ইঁদুর) সাধারণত এই ভাইরাসের বাহক হিসাবে কাজ করে।
খাদ্যগ্রহণ: সংক্রমিত প্রাণীর মাংস খাওয়ার মাধ্যমে (যা অনেক সময়ে সঠিকভাবে রান্না করা হয় না) এম পক্স সংক্রমিত হতে পারে। এটি বিশেষত সেইসব অঞ্চলে সাধারণ, যেখানে বন্যপ্রাণী খাদ্য হিসাবে ব্যবহৃত হয়।
মানুষের মধ্যে সংক্রমণ: একবার একজন ব্যক্তি সংক্রমিত হলে, ভাইরাসটি মানুষ থেকে মানুষের মধ্যে ছড়াতে পারে। সংক্রমণ সাধারণত দীর্ঘস্থায়ী সংস্পর্শের মাধ্যমে ঘটে, যেমন পরিবারের সদস্যদের মধ্যে, বা রোগীর যত্ন নেওয়ার সময়। ভাইরাসটি শারীরিক তরল, শ্বাস-প্রশ্বাসের ড্রপলেট এবং ত্বকের ক্ষতের মাধ্যমে ছড়াতে পারে।
এম পক্সের লক্ষণ
প্রাথমিক লক্ষণ: এম পক্স সংক্রমণের পর সাধারণত ৬ থেকে ১৩ দিনের মধ্যে লক্ষণগুলো প্রকাশ পেতে শুরু করে, যদিও এটি ৫ থেকে ২১ দিনের মধ্যেও হতে পারে। প্রাথমিক লক্ষণগুলির মধ্যে রয়েছে জ্বর, মাথাব্যথা, পেশীতে ব্যথা, ক্লান্তি, এবং শিরদাঁড়ায় ব্যথা।
রোগের পূর্ণাঙ্গ লক্ষণ: কয়েকদিন পর রোগী ত্বকের ফুসকুড়ি, বিশেষ করে মুখমণ্ডল এবং হাত-পায়ের তালুতে ফুসকুড়ি দেখা দেয়, যা পরবর্তীতে সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়তে পারে। এই ফুসকুড়ি প্রথমে সমতল থাকে, পরে এটি ফোসকা এবং পূঁজযুক্ত ক্ষতে পরিণত হয়, এবং শেষপর্যন্ত শুকিয়ে পড়ে যায়।
এম পক্সের প্রভাব
স্বাস্থ্যগত প্রভাব: এম পক্সের লক্ষণগুলি সাধারণত ২ থেকে ৪ সপ্তাহের মধ্যে স্বাভাবিকভাবে সেরে যায়, তবে কিছু ক্ষেত্রে এটি মারাত্মক হতে পারে। বিশেষ করে শিশু, গর্ভবতী নারী এবং যারা ইমিউনোকম্প্রোমাইজড (অর্থাৎ, যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল) তাদের মধ্যে জটিলতা বেশি দেখা যায়। মারাত্মক ক্ষেত্রে, ভাইরাসটি নিউমোনিয়া, এনসেফালাইটিস (মস্তিষ্কের প্রদাহ), এবং চোখের সংক্রমণ হতে পারে, যা অন্ধত্বের ঝুঁকি বাড়ায়।
মৃত্যুহার: আফ্রিকার বিভিন্ন অঞ্চলে এম পক্সের মৃত্যুহার প্রায় ১% থেকে ১০% পর্যন্ত হতে পারে। তবে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই রোগটি তুলনামূলকভাবে কম মারাত্মক এবং সাধারণ চিকিৎসা গ্রহণের মাধ্যমে নিরাময় হয়।
সমাজ ও অর্থনীতির ওপর প্রভাব: যদিও এম পক্সের প্রাদুর্ভাব সাধারণত ছোট এলাকায় সীমাবদ্ধ থাকে, তবে এর প্রভাব বেশ দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, আক্রান্ত ব্যক্তিদের কর্মক্ষমতা কমে যায়, যা তাদের জীবনযাত্রার মানের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এছাড়া, সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে এটি স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার ওপর চাপ বাড়াতে পারে।
এম পক্সের প্রতিরোধ
এম পক্স একটি জুনোটিক ভাইরাসজনিত রোগ, যা মূলত পশু থেকে মানুষের মধ্যে সংক্রমিত হয়। যেহেতু এটি একটি সংক্রামক রোগ, তাই প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নিম্নরূপ:
জনসচেতনতা বৃদ্ধি: জনসাধারণের মধ্যে এম পক্স সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করা অত্যন্ত জরুরি। মানুষকে এই ভাইরাসের সংক্রমণ পদ্ধতি, লক্ষণ এবং প্রতিরোধের উপায় সম্পর্কে জানানো উচিত। বিশেষ করে যেখানে রোগটির প্রাদুর্ভাবের সম্ভাবনা বেশি, যেমন আফ্রিকার গ্রীষ্মমণ্ডলীয় বনাঞ্চল, সেখানে সচেতনতামূলক প্রচারণা চালানো উচিত।
জেনে নিন: পেটের মেদ কমানোর সহজ ও কার্যকর উপায়
প্রাণীর সংস্পর্শ এড়ানো: বন্যপ্রাণী, বিশেষ করে কাঠবিড়ালি, ইঁদুর, এবং অন্যান্য রডেন্টসের সাথে সরাসরি সংস্পর্শ এড়িয়ে চলা উচিত। পশুপাখির মাংস সঠিকভাবে রান্না না করলে তা খাওয়া থেকে বিরত থাকা উচিত।
সুরক্ষা সরঞ্জাম ব্যবহার: স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারীদের, যারা সংক্রমিত রোগীর যত্ন নেন, তাদের সঠিক ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জাম (PPE) যেমন গ্লাভস, মাস্ক, এবং গাউন পরা উচিত।
ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতা: নিয়মিতভাবে হাত ধোয়া এবং অন্যান্য ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতা রক্ষা করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
টিকা প্রদান: স্মলপক্স ভ্যাকসিন (যা এম পক্সের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত) এম পক্সের বিরুদ্ধে কিছু প্রতিরোধ ক্ষমতা প্রদান করতে পারে। কিছু দেশে, বিশেষ করে যেখানে এম পক্স প্রাদুর্ভাবের আশঙ্কা বেশি, সেখানে স্মলপক্সের পুরনো টিকা এখনও ব্যবহৃত হয়।
প্রাদুর্ভাব নিয়ন্ত্রণ আইসোলেশন: সংক্রমিত ব্যক্তিদের সুস্থ মানুষ থেকে বিচ্ছিন্ন রাখা (আইসোলেশন) খুব জরুরি। করোনা মহামারীর সময় যেমনটা করা হয়েছিল ঠিক তেমন। এতে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা কমে যায়।
এম পক্সের চিকিৎসা
এম পক্সের জন্য বিশেষভাবে অনুমোদিত কোনো অ্যান্টিভাইরাল ওষুধ নেই, তবে বেশ কিছু চিকিৎসা পদ্ধতি রয়েছে যা রোগের লক্ষণগুলি প্রশমিত করতে এবং সংক্রমণের তীব্রতা কমাতে সাহায্য করতে পারে। চিকিৎসা পদ্ধতি নিম্নরূপ—
লক্ষণ অনুযায়ী চিকিৎসা: রোগীর শারীরিক অবস্থার ওপর ভিত্তি করে, প্রয়োজনীয় শারীরিক সমর্থন প্রদান করা হয়। যেমন, শরীরের তরল সমতা বজায় রাখা, ব্যথা কমানোর জন্য পেইন কিলার, এবং জ্বর কমানোর জন্য অ্যান্টি-পাইরেটিক ওষুধ প্রদান।
সংক্রমণের তীব্রতার ওপর নির্ভর করে, রোগীর হাসপাতালে ভর্তির প্রয়োজন হতে পারে, বিশেষত যদি রোগীর শ্বাস-প্রশ্বাসে সমস্যা বা গুরুতর শারীরিক অবস্থা দেখা দেয়।
অ্যান্টিভাইরাল চিকিৎসা: কিছু অ্যান্টিভাইরাল ওষুধ, যেমন Tecovirimat (Tpoxx), ব্রিটেনে ২০২২ সালে এম পক্সের জন্য ব্যবহারের অনুমোদন পেয়েছে। এটি পক্সভিরিডি পরিবারের ভাইরাসগুলির বিরুদ্ধে কার্যকর, এবং মাঙ্কিপক্স সংক্রমণ কমাতে সহায়ক হতে পারে।
অন্য দুটি অ্যান্টিভাইরাল ওষুধ, যেমন Cidofovir এবং Brincidofovir, পরীক্ষামূলকভাবে এম পক্সের জন্য ব্যবহৃত হয়েছে, তবে এদের কার্যকারিতা নিয়ে আরও গবেষণা চলছে।
জটিলতা মোকাবিলা: এম পক্সের সংক্রমণ থেকে উদ্ভূত বিভিন্ন জটিলতা, যেমন সেকেন্ডারি ব্যাকটেরিয়াল সংক্রমণ, নিউমোনিয়া, এবং এনসেফালাইটিস চিকিৎসা করা গুরুত্বপূর্ণ। এমন পরিস্থিতিতে অ্যান্টিবায়োটিক এবং অন্যান্য বিশেষজ্ঞ যত্ন প্রয়োজন হতে পারে।
ভ্যাকসিনেশন পরবর্তী চিকিৎসা: যারা উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ গোষ্ঠীর মধ্যে রয়েছে বা যারা সংক্রমণের পরে উচ্চ ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে, তাদের জন্য ভ্যাকসিন গ্রহণের পরে প্রতিরোধমূলক চিকিৎসা শুরু করা যেতে পারে। এটি সংক্রমণের তীব্রতা কমাতে সহায়ক হতে পারে।
বিশ্বব্যাপী বর্তমান পরিস্থিতি
এম পক্স বা মাঙ্কিপক্স দীর্ঘদিন ধরে একটি স্থানীয় সংক্রামক রোগ হিসেবে পশ্চিম ও মধ্য আফ্রিকার গ্রীষ্মমণ্ডলীয় বনাঞ্চলগুলোতে সীমাবদ্ধ ছিল। আফ্রিকার এই অঞ্চলগুলিতে নিয়মিতভাবে এম পক্সের ছোট ছোট প্রাদুর্ভাব দেখা যেত, বিশেষ করে যেখানে বন্যপ্রাণীর সাথে মানুষের সংস্পর্শ বেশি ছিল। ১৯৭০ সালে কঙ্গো গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রে প্রথম মানব সংক্রমণ সনাক্ত হওয়ার পর থেকে এম পক্স একটি স্থানীয় স্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে বিবেচিত হয়েছিল।
২০০৩ সালে, এম পক্সের প্রাদুর্ভাব প্রথমবারের মতো আফ্রিকার বাইরে ঘটে। যুক্তরাষ্ট্রের মিডওয়েস্ট অঞ্চলে গাম্বিয়ান বিশাল ইঁদুর এবং প্রেইরি কুকুরের মাধ্যমে এই প্রাদুর্ভাব ঘটে। এটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন রাজ্যে ৪৭টি সংক্রমণের ঘটনা তৈরি করে, যা তখনো পর্যন্ত আফ্রিকার বাইরে সবচেয়ে বড় প্রাদুর্ভাব ছিল। এই প্রাদুর্ভাবটি প্রমাণ করে যে এম পক্স কেবল একটি স্থানীয় সমস্যা নয়, এটি আন্তর্জাতিক পর্যায়েও স্বাস্থ্য ঝুঁকি তৈরি করতে পারে।
২০২২ সালের শুরুর দিকে, এম পক্স একটি আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য সংকটে পরিণত হয়। কেননা তখন বিশ্বব্যাপী করোনা মহামারী চলছে। একই সাথে আফ্রিকায় তাল মিলিয়ে চলছে এমন পক্স। কিন্তু ওই সময় বিশ্বের প্রতিটা দেশ করোনা থেকে বাঁচার জন্য বিদেশ থেকে আগত প্রত্যেকের করোনা পরীক্ষা এবং বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করত। ফলে বিশ্বব্যাপী এটার ছড়িয়ে যাওয়া রোধ হয়।
২০২৪ সালের শুরু থেকে এই পর্যন্ত আফ্রিকায় ১৪ হাজারের বেশি মানুষ এই রোগে আক্রান্ত হয়েছে। সাড়ে চারশোর বেশি মানুষ মৃত্যুবরণ করেছে। দিন দিন এটার সংক্রামণ বেড়েই চলছ। তবে এখনো ব্যাপক হারে বহির্বিশ্বে ছড়িয়ে যাবার কোনো খবর পাওয়া যায়নি।
এম পক্স প্রতিরোধে কী কী প্রতিকূলতা আছে?
এম পক্সের বিরুদ্ধে লড়াই করার ক্ষেত্রে বেশ কিছু প্রতিকূলতা রয়েছে যা কার্যকর প্রতিরোধ এবং নিয়ন্ত্রণে বাধা সৃষ্টি করছে। প্রধান প্রতিকূলতাগুলো হলো—
জনস্বাস্থ্য পরিকাঠামোর অভাব: উন্নয়নশীল দেশগুলোতে, বিশেষ করে আফ্রিকার গ্রামীণ অঞ্চলে, জনস্বাস্থ্য পরিকাঠামোর অভাব রয়েছে। এম পক্স শনাক্তকরণ, রোগীদের পর্যবেক্ষণ এবং রোগ নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম এবং মানবসম্পদের অভাব রয়েছে।
ভ্যাকসিনের অপ্রতুলতা: এম পক্সের বিরুদ্ধে কার্যকর ভ্যাকসিনের সরবরাহ সীমিত। যেসব দেশে প্রাদুর্ভাব ঘটেছে, সেখানে ভ্যাকসিনের প্রয়োজন মেটানো একটি বড় চ্যালেঞ্জ। ভ্যাকসিন উৎপাদন এবং বিতরণ ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতা প্রাদুর্ভাব নিয়ন্ত্রণের প্রচেষ্টায় ব্যাঘাত ঘটাতে পারে।
জনসচেতনতার অভাব ও ভুল ধারণা: আফ্রিকার যেসব অঞ্চলে এ রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটছে, সেসব অঞ্চলে মানুষজন নিরক্ষর। তাদের মধ্যে কুসংস্কার অনেক বেশি। অনেকে এই রোগটাকে ঈশ্বরের অভিশাপ বা শাস্তি হিসেবে বিশ্বাস করে। তাই রোগাক্রান্ত ব্যক্তিকে কটাক্ষের শিকার হতে হয়। অনেক সময় সঠিক চিকিৎসাও হয় না। জনসচেতনতা ও ভুল ধারণার জন্য এ রোগ বৃদ্ধি পেতে পারে।
আন্তর্জাতিক সহযোগিতার অভাব: এম পক্স একটি ছোঁয়াচে রোগ হওয়ায় এটি সহজেই এক দেশ থেকে অন্য দেশে ছড়াতে পারে। এছাড়া এই রোগ নিয়ন্ত্রণের জন্য তহবিল খুব কম। আন্তর্জাতিকভাবে এর তহবিল বৃদ্ধি না করলে এই রোগ আক্রান্তের সংখ্যা দিন দিন আরও বৃদ্ধি পাবে।
গবেষণার অভাব: এম পক্স সম্পর্কে এখনও অনেক কিছু জানার বাকি রয়েছে। রোগটির প্রকৃতি, সংক্রমণ পদ্ধতি, এবং দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব সম্পর্কে আরও গবেষণা প্রয়োজন। তবে, গবেষণা কার্যক্রমের জন্য পর্যাপ্ত তহবিল এবং বৈজ্ঞানিক সহযোগিতার অভাব একটি বড় চ্যালেঞ্জ।
বন্যপ্রাণী সংস্পর্শ নতুন করে প্রাদুর্ভাবের ঝুঁকি: এম পক্সের প্রাথমিক সংক্রমণ মূলত বন্যপ্রাণীর মাধ্যমে ঘটে। বন উজাড়, জনসংখ্যা বৃদ্ধি, এবং পশুসম্পদ বৃদ্ধির কারণে মানুষের বন্যপ্রাণীর সাথে যোগাযোগের সম্ভাবনা বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা নতুন প্রাদুর্ভাবের ঝুঁকি বাড়িয়ে তুলছে।
ভাইরাসের পরিবর্তনশীলতা: এম পক্স ভাইরাসের জেনেটিক পরিবর্তন বা মিউটেশন ঘটলে এর সংক্রমণ পদ্ধতি, তীব্রতা, এবং প্রতিরোধের কার্যকারিতা পরিবর্তিত হতে পারে। এটি ভবিষ্যতে এম পক্সের নিয়ন্ত্রণ এবং চিকিৎসার জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হতে পারে।
বাংলাদেশে এম পক্সের প্রভাব
এম পক্সের প্রাদুর্ভাব আফ্রিকার দরিদ্র দেশগুলোতে অনেক বেশি। বাংলাদেশের বেশিরভাগ প্রবাসী মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে কাজ করে। কিছু সংখ্যক আছে ইউরোপে। কিন্তু যেখানে এম পক্সের প্রাদুর্ভাব, সে সকল দেশ দরিদ্র হওয়াতে সেখানে বাংলাদেশের মানুষজনের যাতায়াত নেই বললেই চলে। তাই বাংলাদেশ এদিক দিয়ে কিছুটা সুরক্ষিত। তবে ঐ সকল দেশ থেকে অনেক মানুষ জীবিকার তাগিদে বাংলাদেশে আসে। পড়ালেখা করার জন্য আসে। তাদের মাধ্যমে ছড়াবার আশঙ্কা থেকে যায়।
তবে সোশ্যাল মিডিয়ায় বেশ কিছু এম পক্সে আক্রান্তের খবর পাওয়া গিয়েছে। যেগুলো সম্পূর্ণ গুজব। তবে সাবধানে থাকা উচিত। আফ্রিকার ঐ সকল দেশগুলোতে এখন ভ্রমণ করতে যাওয়াটা নিরাপদ নয়।
উপসংহার
এম পক্স একটি বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্য সংকট হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে, যা নিয়ন্ত্রণ এবং প্রতিরোধের জন্য উল্লেখযোগ্য চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। তবে, সঠিক পরিকল্পনা এবং কার্যকর উদ্যোগের মাধ্যমে এই চ্যালেঞ্জগুলি মোকাবিলা করা সম্ভব। আন্তর্জাতিক সহযোগিতা, গবেষণা ও উন্নয়ন, এবং জনসচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে এম পক্সের প্রাদুর্ভাব নিয়ন্ত্রণে সফলতা অর্জন করা যেতে পারে। ভবিষ্যতে এই ধরনের রোগের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য আরও দৃঢ় এবং সুসংগঠিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন।
সম্মানিত ভিজিটর আমি আব্দুল কাইয়ুম, পেশায় আমি একজন গণমাধ্যমকর্মী। ব্লগ বলেন আর সংবাদ বলেন এটাই আমার প্রিয়। এই ব্লগের মাধ্যমে আমি সঠিক তথ্য প্রদানের মাধ্যমে ভিজিটরদের সহযোগিতা করার ছোট্র প্রয়াস।