বর্তমানে মধ্যবয়সী থেকে শুরু করে বৃদ্ধদের মাঝে হাঁটুর ব্যথার প্রবণতা অনেক বেশি। বার্ধক্য জনিত ব্যথা ছাড়াও নানা কারণে হাঁটুর ব্যথা হতে পারে। তাই এসকল অবস্থা থেকে পরিত্রান পেতে, জেনে নিন- হাঁটুর ব্যথা সারানোর ঘরোয়া উপায় গুলো।
আঘাত বা বয়সজনিত কারনে হাঁটুর ব্যথার সমস্যায় ভুগছেন এমন মানুষের সংখ্যা নিতান্তই কম নয়। এর জন্য সঠিক ডাক্তারি চিকিৎসা অনেক সময়ই পাওয়া যায় না। কিংবা আপনার ব্যথার জন্য কার্যকর হয়ে উঠেনা। তাই হাঁটুর ব্যথা সারানোর ঘরোয়া উপায় গুলো ব্যবহার করে এর থেকে পরিত্রাণ পেতে পারেন।
হাঁটুর ব্যথা কেন হয়
হাঁটুর ব্যথা বিভিন্ন কারণে হতে পারে। বিশেষ করে বয়স্ক ব্যক্তিদের হাঁটু সহ বিভিন্ন জয়েন্টে ব্যথা সম্পর্কে আমরা কমবেশি জানি। সাধারণত শরীরে কিছু ভিটামিন বা খনিজ পদার্থের ঘাটতি, দেহের ওজন বেশি হলে, দুটি হাড়ের মাঝে থাকা জেলির মতো পদার্থ কমে গেলে, বা অন্যান্য কারণে এই সমস্যা হতে পারে। হাঁটুর ব্যথা সারানোর ঘরোয়া উপায়’র মাঝে
হাঁটুতে ব্যথার সবচেয়ে বড় কারণগুলো হলোঃ-
- মানুষের হাঁটুর সামনে অবস্থিত একটি অস্থিকে প্যাটেলা বলা হয়। প্যাটেলার পাশে অবস্থিত রগে আঘাত পেলে, প্যাটেলার ফ্রাকচার হলে, কালশিরা, সংযোগকারী তরুণাস্থির ক্ষয়সহ নানাবিধ কারণে হাঁটুর জয়েন্টে ব্যথা হতে পারে।
- মানুষের হাঁটুর সামনে থলির মতো একটি অংশ থাকে। এর নাম প্রিপ্যাটেলার বার্সা। এটি অস্থি এবং পেশি, রগ, লিগামেন্টের মাঝে ঘর্ষন থেকে রক্ষা করা। দীর্ঘসময় হাঁটু গেড়ে বসে কাজ করলে কিংবা হাঁটুতে সামান্য তীব্রতায় ক্রমাগত আঘাত পেলে এই স্থানে “হাউজমেইড’স নী” নামে একটি অবস্থার সৃষ্টি হয়। যার ফলে হাঁটুতে ব্যথা হতে পারে।
- খেলাধুলার সময় এন্টেরিয়োর ক্রুশিয়েট লিগামেন্ট ছিঁড়ে গেলে হাঁটুতে ব্যথা হয়।
- যেসব আর্থ্রাইটিস হাঁটুর জয়েন্টকে আক্রান্ত করে, তার মধ্যে সবচেয়ে কমন টাইপ হচ্ছে অস্টিওআর্থ্রাইটিস। এটি একটি ডিজেনারেটিভ প্রক্রিয়া, যেখানে অস্থিসন্ধির তরুণাস্থি ধীরে ধীরে ক্ষয় হয়ে যায়। মধ্যবয়স্ক এবং বৃদ্ধ বয়সীদের হাঁটুতে ক্রমাগত আঘাত পেলে অস্থি জয়েন্টে চাপ বেড়ে গিয়েও অস্টিওআর্থ্রাইটিস হতে পারে।
- দীর্ঘস্থায়ী ইরিটেশনের কারণে প্যাটেলার চারপাশে অবস্থিত টিস্যু গুলোর ইলাস্টিসিটি হারিয়ে ফাইব্রোটিক ব্যান্ড তৈরি হয়। যা হাঁটুতে ব্যথার কারন।
- কিছু ইনফেকশন থেকে এই সমস্যা হয়।
* * এছাড়াএ আরও বিভিন্ন কারনে হাঁটুতে ব্যথা হতে পারে।
হাঁটুর ব্যথা সারানোর ঘরোয়া উপায়
বর্তমানে বিভিন্ন ওষুধ এবং শারীরিক থেরাপি সহ হাঁটুর ব্যথার জন্য অনেকগুলো চিকিৎসা রয়েছে। কিন্তু তা থেকে সর্বদা ভালো ফলাফল পাওয়া যায় না। তাই হাঁটুর ব্যথা আমাদের জীবনের একটি তিক্ত অভিজ্ঞতার সৃষ্টি করে। বেশ কিছু ঘরোয়া পদ্ধতি রয়েছে যেগুলো ব্যবহার করে আমরা হাঁটুর ব্যথা অনেকাংশে কমাতে পারি। তাহলে কিছু কার্যকর হাঁটুর ব্যথা সারানোর পদ্ধতি গুলো সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাকঃ
(১) আদার ব্যবহার
আদা একটি প্রাকৃতিক অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন উপাদান। আদা শরীরের বিভিন্ন জয়েন্টের ব্যথা কমাতে সাহায্য করে। ব্যবহারের জন্য অল্প পরিমানে আদা থেঁতলে এক কাপ ফুটন্ত পানিতে যোগ করুন। তারপর মিশ্রনটি ১০ মিনিটের জন্য রেখে দিন। এবার তা ছেঁকে চায়ের সাথে পান করুন। নিয়মিত ব্যবহারে আপক্নার দীর্ঘমেয়াদী হাঁটুর ব্যথা থেকে পরিত্রান পেতে পারেন।
(২) হলুদ ও দুধের মিশ্রন
হলুদ এমন একটি মশলা যার ব্যথানাশক ও ক্ষতস্থানে যন্ত্রণা প্রতিরোধী বৈশিষ্ট্য রয়েছে। এটি হাঁটুতে ব্যথা কমাতেও সাহায্য করতে পারে। শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ব্যথায় মানষ আদিকাল থেকেই হলুদের ব্যবহার করে আসছে। হাঁটুর ব্যথা সারানোর ঘরোয়া উপায় হিসেবে হলুদের ব্যবহার করতে চাইলে, এক কাপ গরম দুধের সাথে এক চা চামচ হলুদের গুঁড়া মিশিয়ে নিন। রাতে ঘুমানোর আগে তা পান করুন। অল্প সময়ের মধ্যেই এর উপকারিতা লক্ষ্য করতে পারবেন।
(৩) নিয়মিত ম্যাসাজ করুন
রক্তের প্রবাহ বাড়াতে এবং পেশীর টান কমিয়ে হাঁটুর ব্যথা উপশম করতে একটি কার্যকর উপায় হলো ম্যাসাজ বা মালিশ করা। কোন ব্যথা নিরোধক মলম দিয়ে নিয়মিত ম্যাসাজ করুন। আপনার আঙ্গুল দিয়ে বা ম্যাসাজ বল দিয়ে আক্রান্ত স্থানে মৃদু চাপ দিয়ে ম্যাসাজ করতে হবে। এর পাশাপাশি অন্যান্য বিষয়গুলোও মানতে হবে।
(৪) নিয়মিত হালকা ব্যায়াম
ব্যায়াম কে আমরা ব্যথা কমানোর বিপরীতমুখী বলে মনে করে থাকি। অনেকেই ভাবেন ব্যায়াম আমাদের হাঁটুর ব্যথা বৃদ্ধি করে। কিন্তু ব্যায়াম হাঁটুর চারপাশের পেশীগুলিকে শক্তিশালী করে এবং নমনীয়তা বৃদ্ধি করে। ফলে হাঁটুর ব্যথা উপশম হয়। তবে এক্ষেত্রে ভারি ব্যায়াম করা যাবেনা। আপনার জন্য উপযুক্ত কিছু হালকা ব্যায়াম, যেমন- সাঁতার কাটা, সাইকেল চালানো এবং যোগব্যায়াম হাঁটুর ব্যথায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের জন্য অত্যন্ত উপকারি।
অত্যাধিক ব্যথা হলে কাফ মাসল স্ট্রেচ নামক ব্যায়াম টি করতে পারেন। এটি হাঁটুর ব্যথা সারানোর ঘরোয়া উপায়ের মধ্যে একটি। এক্ষেত্রে সমতল ভূমিতে প্রথমে একটি পা ১৫-৩০ সেকেন্ড স্ট্রেচ করে ধরে রাখুন। তারপর একই পদ্ধতিতে অন্য পায়েও করুন।
(৫) দেহের ওজন নিয়ন্ত্রনে রাখা
হাঁটুর ব্যথায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি হলো যাদের দেহের ওজন বেশি, এমন ব্যক্তিরা। শরীরের ওজন বেশি হওয়ার কারনে হাঁটুর জয়েন্টগুলোতে চাপ সৃষ্টি হয়। চলাফেরায় অসুবিধা হয়, লিগামেন্ট এ চাপ পড়ে এবং অন্যান্য সমস্যাও দেখা দেয়। তাই নিজের সুস্বাস্থ্যের জন্য ওজন নিয়ন্ত্রনে রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
(৬) বিশ্রামে থাকা
হাঁটুর ব্যথা সারানোর ঘরোয়া উপায় গুলোর পাশাপাশি বিশ্রাম করা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এসময় হাঁটুতে চাপ সৃষ্টিকারী কার্যকলাপ গুলো থেকে বিরত থাকুন। যেমন- দৌড়ানো বা লাফ দেওয়া, অনেক ভারী কাজ করা ইত্যাদি। বিশ্রাম ব্যথা কমাতে সহায়তা করে। পাশাপাশি গভীর শ্বাস বা ধ্যানের মতো শিথিলকরণ কৌশল গুলো অনুশীলন করতে পারেন। এটিও চাপ কমাতে সাহায্য করে।
(৭) তাপ থেরাপি দেওয়া
হিট থেরাপি/ তাপ থেরাপি হাঁটুর ব্যথার জন্য সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত প্রতিকার। সাধারনত ডাক্তারি ক্লিনিকে গেলে হাঁটুর ব্যথার জন্য আমাদের এই তাপ থেরাপি দেওয়া হয়। আপনি চাইলে নিজেই ঘরোয়াভাবে এটি ব্যবহার করতে পারেন।
ব্যথার স্থানে তাপ থেরাপি দিলে রক্ত প্রবাহ বাড়ে, চাপ কমে ও ব্যথা কমতে থাকে। হিটার কিংবা অন্যান্য উপায়ে হালকা গরম তাপ হাঁটুতে প্রয়োগ করুন। তাছাড়া পানি গরম করে তার পাত্র থেকে কাপড়ের মাধ্যমেও ছ্যাঁকা দিতে পারেন। তবে খেয়াল রাখবেন যেন খুব বেশিক্ষণ তার প্রয়োগ করা না হয়। এতে অস্বস্তিকর অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে।
(৮) আইস থেরাপি দেওয়া
হাঁটু ব্যথার জন্য সবচেয়ে কার্যকর ঘরোয়া প্রতিকারের একটি হলো আইস থেরাপি। ব্যথাযুক্ত স্থানে বরফ ব্যবহার করা হলে, তা ফোলা এবং ব্যথা উপশম করতে উপকারী। আইস থেরাপি ব্যবহার করার জন্য, শুধুমাত্র একটি কোল্ড প্যাক বা ঠান্ডা একটি ব্যাগ কিংবা বরফে একটি তোয়ালে মুড়ে দিন। তারপর দিনে কয়েকবার ১৫-২০ মিনিট করে হাঁটুতে লাগান এবং হালকাভাবে ম্যাসাজ করুন। এটি হাঁটুর ব্যথা সারানোর ঘরোয়া পদ্ধতি গুলোর মধ্যে অত্যন্ত কার্যকর।
আরো পড়ুন: পেটের মেদ কমানোর কার্যকর উপায়
উপরোক্ত হাঁটুর ব্যথা সারানোর ঘরোয়া উপায় গুলো ব্যবহার করে আপনি ভালো ফলাফল পেতে পারেন। তবে ব্যথা দীর্ঘস্থায়ী হলে এবং তীব্রতর হলে অবশ্যই বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শ নিন।
হাঁটুর ব্যথা সারানোর ঔষধ
হাঁটুর ব্যথা সারানোর বিভিন্ন ঔষধ বাজারে পাওয়া যায়। এর মধ্যে একটি হলো, ডিক্লোমল ট্যাবলেট (Diclomol Tablet)। এটি একটি নন-স্টেরয়েডাল অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি ড্রাগ (NSAID) বা স্টেরয়েড নয় এমন একটি প্রদাহ-বিরোধী ওষুধ।
এই ঔষধ সেবনে আপনার ব্যথা, প্রদাহ, জয়েন্ট বা গাঁটে ব্যথা এবং ফোলা থেকে মুক্তি দিতে পারে। তাছাড়া আপনার নিকটস্থ বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী অন্যান্য ঔষধ সেবন করতে পারে।
হাঁটুর ব্যথা সারানোর ব্যায়াম
হাঁটুর ব্যথা সারানোর জন্য কিছু হালকা ব্যায়াম, যেমন- সাঁতার কাটা, সাইকেল চালানো এবং যোগব্যায়াম করতে পারেন। তবে খুব বেশি ব্যথা হলে কাফ মাসল স্ট্রেচ (Calf Muscle Stretch) নামক ব্যায়াম টি করতে পারেন। এর জন্য সমতল ভূমিতে প্রথমে একটি পা ১৫-৩০ সেকেন্ড স্ট্রেচ করে ধরে রাখুন। তারপর একই পদ্ধতিতে অন্য পায়েও এই ব্যায়াম করুন। ধারাবাহিকভাবে কয়েকবার করতে পারেন।
তাছাড়া বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ অনুযায়ী অন্যান্য ব্যায়াম করতে পারেন।
শেষকথা
বর্তমানে বহু হাঁটুর ব্যথা সারানোর ঘরোয়া উপায় রয়েছে। উপরোক্ত উপায় গুলো আপনার ব্যথা কমাতে এবং পুরোপুরি নিরাময় করতে কার্যকর ভূমিকা রাখবে। তবে আপনার হাঁটুর ব্যথা দীর্ঘস্থায়ী হয় বা তীব্র হয়ে ওঠে, তাহলে দ্রুত ডাক্তারি পরামর্শ নেওয়া উচিত।
সম্মানিত ভিজিটর আমি আব্দুল কাইয়ুম, পেশায় আমি একজন গণমাধ্যমকর্মী। ব্লগ বলেন আর সংবাদ বলেন এটাই আমার নেশা ও পেশা। এই ব্লগের মাধ্যমে ভিজিটরদের সঠিক তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করাই আমার ছোট্ট প্রয়াস মাত্র।