ডায়রিয়ার লক্ষণ – ডায়রিয়া হলে করনীয় কি ? ডায়রিয়া একটি সাধারণ স্বাস্থ্য সমস্যা, যা প্রায় সকলের জীবনেই কোনো না কোনো সময়ে ঘটে থাকে। অধিকাংশ সময় ডায়রিয়া একটি সাধারণ রোগ হিসেবেই প্রকাশ পায়। তবে কিছু ক্ষেত্রে এটি গুরুতর হতে পারে এবং জীবননাশের কারণও হতে পারে। তাই ডায়রিয়া হলে উপযুক্ত চিকিৎসা না নিয়ে উপেক্ষা করা উচিত নয়।
আমাদের সকলেরই এই বিশেষ শারীরিক সমস্যা সম্পর্কে স্বাস্থ্য সচেতন থাকা উচিত। তাই ডায়রিয়া হওয়ার কারণ, ডায়রিয়ার লক্ষণ, ডায়রিয়া হলে করনীয় কি এবং ডায়রিয়া প্রতিরোধ করার উপায় সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নেই এই লেখা থেকে।
ডায়রিয়া হওয়ার কারণ Diarrhea
ডায়রিয়া বিভিন্ন কারণে হতে পারে। তবে এর প্রধান ও উল্লেখযোগ্য কারণগুলো হলো:
- ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ: খাদ্য বা পানীয়ের মাধ্যমে বিভিন্ন ব্যাকটেরিয়া প্রবেশ করলে, যেমন- ই-কোলাই, সালমোনেলা, শিগেলা, কোলেরা ইত্যাদি দেহে প্রবেশ করলে ডায়রিয়া হতে পারে।
- ভাইরাসের সংক্রমণ: রোটাভাইরাস, নোরোভাইরাস, অ্যাডেনোভাইরাস এবং অ্যাস্ট্রোভাইরাস প্রভৃতি ভাইরাসও ডায়রিয়ার কারণ হতে পারে।
- পরজীবীর সংক্রমণ: পানির মাধ্যমে গিয়ারডিয়া, ক্রিপ্টোস্পোরিডিয়াম এবং এন্টামিবা হিস্টোলিটিকা পরজীবীর সংক্রমণ হয়ে ডায়রিয়া হতে পারে।
- খাদ্য বিষক্রিয়া বা ফুড পয়জনিং: পচা বা অস্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়ার ফলে ফুড পয়জনিং হতে পারে। এটি ডায়রিয়া হওয়ার অন্যতম বড় কারণ।
- অ্যালার্জি এবং অসহিষ্ণুতা: আমাদের দেহ কিছু খাবারের প্রতি অ্যালার্জি বা অসহিষ্ণু হলে, যেমন- ল্যাকটোজ অসহিষ্ণুতা, গ্লুটেন অসহিষ্ণুতার ডায়রিয়া হতে পারে।
- ঔষধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া: কিছু ঔষধ যেমন অ্যান্টিবায়োটিক এবং ম্যাগনেসিয়াম সমৃদ্ধ অ্যান্টাসিড ডায়রিয়া সৃষ্টি করতে পারে।
- অন্ত্রের রোগ: অনেক সময় অন্ত্রের বিভিন্ন রোগের কারণে ডায়রিয়া হয়ে থাকে। যেমন: ইরিটেবল বাউয়েল সিন্ড্রোম (IBS), ইনফ্ল্যামেটরি বাউয়েল ডিজিজ, ক্রোনস ডিজিজ, আলসারেটিভ কোলাইটিস ইত্যাদি।
ডায়রিয়ার লক্ষণ | ডায়রিয়া হওয়ার লক্ষণ Diarrhea
ডায়রিয়া হলে কিছু সাধারণ লক্ষণ প্রকাশ পায়। একেকজনের জন্য ডায়রিয়ার লক্ষণ একেক রকম হতে পারে-
- ডায়রিয়ার প্রধান লক্ষণ হিসেবে তরল বা পাতলা মলত্যাগ হয়, যা দিনে কয়েকবার হতে পারে।
- পেটে মৃদু থেকে তীব্র ব্যথা হতে পারে।
- ডায়রিয়ার সাথে অনেক সময় বমি বমি ভাব বা বমি হতে পারে।
- কিছু ক্ষেত্রে ডায়রিয়ার সাথে হালকা থেকে উচ্চমাত্রার জ্বরও দেখা দেয়।
- ডায়রিয়ার কারণে শরীরে পানি ও লবণের ঘাটতি দেখা দিতে পারে। এর ফলে পানিশূন্যতার লক্ষণ দেখা দেয়। যেমন: মুখ শুষ্ক হওয়া, তৃষ্ণা অনুভব, মাথা ঘোরা, এবং মূত্রের রং গাঢ় হওয়া ইত্যাদি।
আরও জানতে- পাকস্থলীর ক্যান্সার কেন হয়
ডায়রিয়া হলে করণীয় কি? Diarrhea
ডায়রিয়া হলে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। কারণ এটি শরীরের পানিশূন্যতা এবং অন্যান্য জটিলতা সৃষ্টি করে। ডায়রিয়া হলে যেসকল করণীয় বিষয়গুলো মেনে চলা উচিত, সেগুলো হলো:
(১) পর্যাপ্ত পানি পান করা
ডায়রিয়ার সময় শরীর থেকে প্রচুর পানি ও লবণ বের হয়ে যায়। এ সময় পানিশূন্যতা দেখা দেয়। ডায়রিয়া হওয়ার পর এরকম অবস্থা থেকে পরিত্রান পেতে আমরা ওর স্যালাইন পান করতে পারি। ওআরএস বা Oral Rehydration Solution আমাদের পানিশূন্যতা দূর করার পাশাপাশি, ডায়রিয়া প্রতিরোধ করে এবং শরীরের অবস্থার উন্নতি করে।
এছাড়াও চিনি ছাড়া পর্যাপ্ত পানি, ডাবের পানি, ফলের রস এবং স্যুপ পান করা উচিত। তবে ক্যাফেইন ও অ্যালকোহলযুক্ত পানীয় পরিহার করতে হবে।
(২) হালকা ও সহজপাচ্য খাবার খাওয়া
ডায়রিয়া হলে হালকা খাবার এবং সহজে হজম হবে এমন খাবার খেতে হবে। এক্ষেত্রে ভাত, খিচুড়ি, ওটমিল ইত্যাদি খাবার খেতে পারি। সহজে হজম হয় এমন খাবারের মধ্যে পুষ্টিকর খাবারও যুক্ত করতে হবে। যেমন- কলা, আপেল সস, সিদ্ধ আলু ইত্যাদি। এছাড়াও প্রোটিন সমৃদ্ধ সেদ্ধ বা হালকা রান্না করা মুরগি বা মাছও খেতে পারেন।
(৩) পর্যাপ্ত বিশ্রাম নেওয়া
ডায়রিয়ার সময় শরীর দুর্বল হয়ে যায়। তাই পর্যাপ্ত বিশ্রাম নেওয়া জরুরি। এতে শরীর দ্রুত সুস্থ হতে সুযোগ পায়।
(৪) প্রোবায়োটিকস গ্রহণ
দই, ইয়োগার্ট এবং অন্যান্য প্রোবায়োটিক সমৃদ্ধ খাবার গ্রহণ করতে হবে। এ ধরনের খাবার অন্ত্রের উপকারী ব্যাকটেরিয়ার সংখ্যা বাড়িয়ে দেয় এবং হজম প্রক্রিয়া উন্নত করে।
(৫) পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা
ডায়রিয়া হওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ অপরিচ্ছন্নতা। তাই অন্যান্য সময়ের মতোই ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার পরও খাবার আগে ও পরে এবং টয়লেট ব্যবহারের পরে সাবান দিয়ে ভালোভাবে হাত ধুতে হবে। এছাড়াও খাবার রান্না ও সংরক্ষণে সঠিক স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে।
(৬) চিকিৎসকের পরামর্শে চিকিৎসা নেওয়া
ডায়রিয়া যদি দীর্ঘস্থায়ী হয় বা গুরুতর লক্ষণ দেখা যায়, যেমন- তীব্র পেট ব্যথা, উচ্চমাত্রায় জ্বর, রক্তযুক্ত মল বা প্রচণ্ড পানিশূন্যতা দেখা যায়, তাহলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। এক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী অ্যান্টিবায়োটিক বা অন্যান্য ঔষধ গ্রহণ করতে হবে।
আরও পড়ুন: আলসার কি? কেন হয়, আলসারের প্রকারভেদ, লক্ষণ ও মুক্তির উপায়
শিশুর ডায়রিয়া হলে করণীয় কি Diarrhea
শিশুর ডায়রিয়া হলে বিশেষ যত্ন নিতে হবে। শিশুদের জন্য ঘরে তৈরি ওরস্যালাইন বা লবন-পানি দিতে হবে। পাশাপাশি পর্যাপ্ত পরিমাণে তরল ও পুষ্টিকর খাবার দিতে হবে। শিশু যদি স্তন্যপান করে, তবে স্তন্যপান চালিয়ে যেতে হবে। শিশুর ডায়রিয়া যদি গুরুতর হয় তাহলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
ডায়রিয়া হলে কি কি খাওয়া যাবে না
ডায়রিয়া হলে কিছু খাবার পরিহার করা উচিত। কারণ এগুলো হজম প্রক্রিয়ায় সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে এবং ডায়রিয়ার লক্ষণ আরও গুরুতর করতে পারে। ডায়রিয়া হলে নিম্নোক্ত খাবার ও পানীয় পরিহার করতে হবে:
- দুগ্ধজাত পণ্য: ল্যাকটোজ অসহিষ্ণুতা থেকে রক্ষা পেতে দুধ, পনির, মাখন, আইসক্রিম ইত্যাদি দুগ্ধজাত পণ্য খাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে।
- ফ্যাটযুক্ত খাবার: ফ্যাটযুক্ত খাবার যেমন ভাজাপোড়া, তেলযুক্ত খাবার, ফাস্ট ফুড ইত্যাদি হজমে সমস্যা সৃষ্টি করে। তাই এগুলো খাওয়া যাবে না।
- মশলাদার খাবার: অতিরিক্ত মশলাদার খাবার পেটের জন্য ক্ষতিকর। তাই এই ধরনের খাবার থেকে বিরত থাকা উচিত।
- উচ্চ ফাইবারযুক্ত খাবার: উচ্চ ফাইবারযুক্ত খাবার যেমন কাঁচা সবজি, স্যালাড, এবং আপেল, পেয়ারা ইত্যাদি ফল পরিহার করতে হবে।
- মিষ্টি ও চিনি যুক্ত খাবার: অতিরিক্ত মিষ্টি বা চিনি যুক্ত খাবার, যেমন- ক্যান্ডি, কেক, পেস্ট্রি, সোডা ইত্যাদি খাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে।
- ক্যাফেইনযুক্ত পানীয়: কফি, চা, এবং এনার্জি ড্রিঙ্ক পরিহার করুন।
- অ্যালকোহল: ডায়রিয়ার সময় অ্যালকোহল জাতীয় পানীয় পরিহার করতে হবে।
- গ্লুটেনযুক্ত খাবার:
- গ্লুটেনযুক্ত খাবার, যেমন- রুটি, পাস্তা, বিস্কুট ইত্যাদি ডায়রিয়ার সময় পরিহার করতে হবে।
ডায়রিয়া প্রতিরোধ করার উপায় Diarrhea
একবার ডায়রিয়ার সংক্রমণ হলে আমাদের দেহের ব্যাপকভাবে স্বাস্থ্যহানি ঘটে। তাই ডায়রিয়া হওয়ার পর তার প্রতিকার করার থেকে ডায়রিয়া হওয়ার আগে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলে প্রতিরোধ গড়াই উত্তম। ডায়রিয়া প্রতিরোধ করার জন্য আমাদের যেসকল বিষয়গুলো মেনে চলা উচিত, সেগুলো হলো:
- নিরাপদ ও বিশুদ্ধ পানি পান করুন। প্রয়োজনে পানি ফুটিয়ে বা ফিল্টার করে পান করতে পারেন।
- খাবার আগে ও পরে, টয়লেট ব্যবহারের পরে এবং শিশুদের পরিচর্যার পর ভালোভাবে সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে নিবেন।
- খাবার ভালোভাবে রান্না করুন এবং খাবার পরিবেশনের সময় সঠিক স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলুন।
- পচা বা অস্বাস্থ্যকর খাবার পরিহার করুন এবং তাজা ও স্বাস্থ্যকর খাবার গ্রহণ করুন।
- রোটাভাইরাসের মতো কিছু ভাইরাসজনিত সংক্রমণ প্রতিরোধে টিকা গ্রহণ করতে হবে। সাধারণত জন্মগ্রহণের পর শিশুর বয়স 15 মাস হওয়ার পূর্বেই এ ধরনের টিকাগুলো দিয়ে দেওয়া হয়।
শেষকথা
উপরিক্ত আলোচনা থেকে ডায়রিয়ার লক্ষণ এবং ডায়রিয়া হলে করনীয় কি সে সম্পর্কে জানতে পারলেন। ডায়রিয়া একটি সাধারণ স্বাস্থ্য সমস্যা হলেও, দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া এবং সঠিক যত্ন নেওয়া জরুরি। আর ডায়রিয়া যদি দীর্ঘস্থায়ী হয়, তাহলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
সম্মানিত ভিজিটর আমি আব্দুল কাইয়ুম, পেশায় আমি একজন গণমাধ্যমকর্মী। ব্লগ বলেন আর সংবাদ বলেন এটাই আমার নেশা ও পেশা। এই ব্লগের মাধ্যমে ভিজিটরদের সঠিক তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করাই আমার ছোট্ট প্রয়াস মাত্র।